অথবা, যৌতুকের কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, যৌতুকের আর্থসামাজিক কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, যৌতুকের উল্লেখযোগ্য কারণগুলো লিখ।
উত্তরা৷ ভূমিকা : আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই নারী। কোনো জনগোষ্ঠী উন্নয়নের পথে কতটা এগিয়েছে তার একটি অন্যতম নির্দেশক হলো সেখানকার নারীদের অবস্থানগত তারতম্য। বাংলাদেশের নারীরা পূর্বের তুলনায় উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে। আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্যতার সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু এখনও কিছু কিছু সামাজিক কুপ্রথা নারী সমাজকে আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেও এগুলো বড় হাতিয়ার। যৌতুক হচ্ছে তেমনি একটি সামাজিক কুপ্রথা। যৌতুক প্রথা কোথাও কোথাও সরাসরি আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছদ্মাবরণে সমাজে টিকে আছে। যৌতুকের কারণেই নির্যাতিত হচ্ছে নারী সমাজের একটি বড় অংশ।
যৌতুকের কারণ (Causes of Dowry) : বিবাহিত নারীর উপর সহিংসতার একটি প্রধান কারণ হলো যৌতুক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে নারী নির্যাতন অভিযোগের মধ্যে যৌতুক সংক্রান্ত ৭৪৭টি মামলা রুজু হয়েছে। অর্থাৎ, মামলার সংখ্যা মাসে গড়ে ৬২.২৫টি। ১৯৯৮ সালে মোট মামলা ছিল ৯০৩টি। মাসে গড়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭৫.২৫টি। ১৯৯৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসাব করা মোট মামলার সংখ্যা ৩৯৮টি এবং মাসে গড়ে ৭৯.৬০টি। এ পরিসংখ্যান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রতিবছর যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে।
যৌতুকের কারণগুলো হলো :
i. পাত্রের আর্থিক দুরবস্থা (Financial crisis of the groom) : বিয়ে নারী এবং পুরুষ উভয়ের জীবনেই প্রয়োজন তা অস্বীকার করা যায় না। আমাদের দেশের একটি বিরাট সমস্যা হলো দারিদ্র্য। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও অনেক ছেলে বেকারত্বের কারণে সঠিক সময়ে
বিয়ে করতে পারে না। দিনের পর দিন বেকারত্বের বোঝা আর অর্থনৈতিক দৈন্যদশার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এসব বেকার ছেলেরা কেউ কেউ যৌতুকের দিকে ধাবিত হয়।
ii. মহিলাদের প্রতি ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি (Negative view to the women) : পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা অসহায় ও পুরুষের করুণার পাত্র হিসেবে টিকে থাকে। অনেক পুরুষ নারীদের অধিকার হীন রাখতে চায়। Khondoker Mokaddem Hossain 4, “In encourages the groom’s side to demand a high price for the groom, as an unmarried daughter is a burden in the eyes of society than unmarried son.” অর্থাৎ, অবিবাহিত মেয়ে সমাজের কাছে বোঝা হয়ে থাকে যা পাত্রপক্ষকে যৌতুক দাবি করতে উৎসাহিত করে।
iii. নারীদের পরনির্ভরশীলতা (Dependence of women) : সমাজের যে স্তরেই হোক না কেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে বিয়েতে কমবেশি যৌতুক দিতেই হয়। কারণ পুরুষের উপর নারীর মূলত অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এজন্য দায়ী। বলা যায়, “A dowry is paid to the groom & his kin as a compensation for extra expenses of maintaining the bride who is consideredless productive.” (Rozario 1992). অর্থাৎ, সমাজের ধারণা অনুযায়ী নারী আর্থিক বা উৎপাদনমূলক কাজে দক্ষ নয় । তাই নারীকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় এবং যৌতুক দানে বাধ্য করা হয়।
iv. প্রতিষ্ঠা লাভের মনোভাব (Willingness to be established) : সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যৌতুক দান ও গ্রহণ করতে আগ্রহী। বেকার ছেলেরা যৌতুকের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে চায়। কন্যার পিতার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, টেলিভিশন, ভিসিডি, ফ্রিজ, গাড়ি, ফ্লাট বাড়ি, উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে ভ্রমণের ব্যয়ভার ইত্যাদি আদায় করে থাকে। অনেকে এগুলোকে যৌতুক না বলে বলা হয় Gift বা উপহার।
v. সামাজিক দুর্নীতি (Social corruption) : যৌতুক প্রথা আমাদের সভ্যসমাজে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।যৌতুক সমাজের এক দুরারোগ্য ব্যাধি। যাদের পূর্বের কোনো পারিবারিক পরিচিতি নেই, অথচ হঠ
াৎ করে বিশাল সম্পদ ও কালো টাকার মালিক হয়ে গেছে, এক্ষেত্রে তারাই যৌতুক দানে বেশি উৎসাহী। বস্তুত যাদের ধনসম্পদ ছাড়া (অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত ধনসম্পদসহ) গর্ব করার আর কিছু নেই তাদের মধ্যে আত্মতৃপ্তি ও সামাজিক মর্যাদা লাভের বাসনা নিবৃত্তকরণে যৌতুক একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, যৌতুকের পিছনে নানারকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ বিদ্যমান। তাছাড়া এটি সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চাহিদা হিসেবে দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এ চাহিদা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, একে কেন্দ্র করে শুধু ভুল বুঝাবুঝিই নয় বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মর্মান্তিক হত্যা রাহাজানিও ঘটছে।