১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।

অথবা, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত ও বহু মা-বোনের আত্মত্যাগ ও ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় এ স্বাধীনতা। দীর্ঘ ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তা স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। কোনো প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই বাঙালি
জাতি স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্য : নিচে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচিত করে। ৬ দফা দাবি আদায়, গণঅভ্যুত্থান এবং ‘৭০ এর নির্বাচন ও সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে। কাজেই বাংলাদেশের সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল ।
২. স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর গণহত্যা শুরু করে। প্রতিবাদী বাঙালি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাঠি, তীর, ধনুক প্রভৃতি হাতে তৈরি অস্ত্র নিয়ে শক্তিশালী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
৩. জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, শিক্ষক, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
৪. বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা : ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের নিকট হস্তান্তর না করে বিভিন্ন অজুহাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। ফলে আওয়ামী লীগ সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পর থেকে পূর্ব বাংলার জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৫. মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সিভিল সরকার দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদানের জন্য মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধ সাংগঠনিক রূপ লাভ করে।
৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৭. গণহত্যা : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল গণহত্যা। নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর পাকহানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। গণহত্যার বিভীষিকা রূপ বহির্বিশ্বে প্রচারিত হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইতিবাচক মতামত গড়ে উঠে।
৭. গেরিলা তৎপরতা : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গেরিলা যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির থেকে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর উপর আতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং আক্রমণ শেষে পলায়ন করে। গেরিলা যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ সফলভাবে পরিচালিত হতে থাকে।
৯. বিপুল শরণার্থী : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বিপুল শরণার্থীদের আশ্রয় ও পুনর্বাসন করা । ভারতে প্রায় ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের খাদ্য সরবরাহ, নিরাপত্তা প্রদান ছিল মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্য।
১০. নারীনির্যাতন : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নারীনির্যাতন। Kill, Burn, Rape এ ছিল পাকবাহিনীর মূলনীতি । যার ফলে তারা নারী অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং নারী হত্যার মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয় ।
১১. স্ট্রাইকিং ফোর্স : মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখ থেকে যৌথবাহিনী একযোগে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। যৌথবাহিনীর আক্রমণে দ্রুত পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। কাজেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল অন্যতম ঘটনা।
১২. দ্রুত পরিসমাপ্তি : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সমাপ্ত হয়। মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এত অল্প সময়ে কোনো দেশ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেনি। তাছাড়া ৯৩ হাজার সৈন্য বাহিনী অর্থাৎ এত বিপুল সৈন্যসহ আত্মসমর্পণের ঘটনাও ছিল বিরল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির বেঁচে থাকার দাবি, অস্তিত্ব রক্ষার দাবি। পূর্ব বাংলার জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন।