অথবা, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের উপর টীকা লিখ ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রথম পর্ব হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকদের গড়িমসি ছিল এ অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান কারণ। এ আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন : ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান ছিল। নিচে সেগুলো বর্ণনা করা হলো।
১. ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি : ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পায় ৩১০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন না করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গড়িমসি করতে থাকে।
২. ছাত্র ও শ্রমিকদের কর্মসূচি : ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ স্থগিত ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ছাত্রসমাজ, শ্রমিক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিভিন্ন জায়গায় জনতা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে এতে অনেক মানুষ হতাহত হয়। এরই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠন,
করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’। ৩ মার্চ পল্টনে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয় এবং সমাবেশে ছাত্রলীগ ৫ দফাভিত্তিক প্রস্তাব গ্রহণ করে যা ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ নামে পরিচিত। এ জনসভায় ৪-৬ মার্চ পর্যন্ত অর্ধবেলা হরতাল পালন করা হয় এবং এতে সবাই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলে বাঙালি তা প্রত্যাখ্যান করে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭ মার্চ রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী
উদ্যান) বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার জন্য জনসভার আয়োজন করা হয়।
৩. বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ : ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নামে। এদিনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন। যার মূল বিষয় ছিল চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার করা, গণহত্যার তদন্ত করা, সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং এতে অনেক নির্দেশনাসহ পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আপামর জনতাকে প্রস্তুত হতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের পর থেকেই বাংলাদেশে অসহযোগ ও প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব : ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের তাৎপর্য অপরিসীম। এ আন্দোলনের গুরুত্বকে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়-
১. মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি পর্ব : ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতি পর্ব বলা যেতে পারে। এ আন্দোলন পাকিস্তান শাসনের ভিত দুর্বল করে দেয়। বীর বাঙালি অনেক বাধা সত্ত্বেও প্রমাণ করে তাদের নিকট পাকিস্তান সরকারের নির্দেশের কোন মূল্য নেই !
২. বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনেই প্রমাণিত হয় বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। মূলত ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের প্রশাসন যন্ত্র প্রায় অচল হয়ে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশ পরিচালিত হতে থাকে।
৩. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শিক্ষা : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু একদিকে পাকিস্তানের শোষণ, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি, কর্মসূচি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনে যার যা কি
ছু আছে তাই নিয়ে তাদের মোকাবিলার নির্দেশ দেন। যার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে বাঙালি জাতি সংঘবদ্ধ হয়ে মোকাবিলার জন্য গড়ে তুলতে থাকে মুক্তিবাহিনী যারা ২৫ মার্চের আক্রমণের পরে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। তাই ৭ মার্চের ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলন বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে শিক্ষা দিয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহাকে প্রচণ্ড রকমে জাগ্রত করে যা মার্চের প্রথম থেকেই দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। স্কুল কলেজ, অফিস আদালত, কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়। ১৩ মার্চ সরকার আইন জারি করলেও তা ভঙ্গ করে বাঙালি এগিয়ে যায় এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।