১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর

অথবা, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনের কথা থাকলেও ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারিতে তা স্থগিত হয়। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি : ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণা করেন। এদিকে মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন। এ পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ূব খান তদানীন্তন সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।
জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক আইন জারি করেন; আইয়ুবের সংবিধান বাতিল করেন এবং সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তার উদ্দেশ্য এবং অচিরেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি হতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের উপর সকল বাধা নিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। তিনি ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের জলোচ্ছ্বাস ও দুর্গত এলাকার আসনে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
জেনারেল ইয়াহিয়ার আইনগত কাঠামো আদেশ : ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের ভিত্তি হিসেবে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন গ্রহণ এবং মূলনীতি ও নির্বাচনের পদ্ধতি সংবলিত এক আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন। তার আইনগত কাঠামো আদেশ নিম্নরূপ :
সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতিগত নীতিমালা :
i. সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার নীতি গৃহীত হবে।
ii. এক ব্যক্তি এক ভোট এ নীতি অনুসৃত হবে।
iii. পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে প্রত্যেক প্রদেশ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবে।
সংবিধান সম্পর্কিত মূলনীতি :
i. পাকিস্তান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র এ আলোকেই সংবিধান প্রণয়ন হবে।
ii. সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা, মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
iii. সংবিধানে প্রদেশসমূহের সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন সুনিশ্চিত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কেন্দ্রের হাতে শাসন, আইন পর্যাপ্ত অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
iv. ১২০ দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদকে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে এবং ব্যর্থ হলে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া হবে।
v. জাতীয় পরিষদ কর্তৃক প্রণীত শাসনতান্ত্রিক বিল রাষ্ট্রপতি অনুমোদন ছাড়া সংবিধান রূপ নেবে না।
জাতীয় পরিষদ গঠনের নিয়মাবলি :
i. ৩১৩ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় পরিষদ গঠিত হবে।
ii. জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ৩০০টি সাধারণ আসন এবং বাকি ১৩টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। সাধারণ আসন ভোটে নির্বাচিত হবে।
iii. প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একটি করে প্রাদেশিক পরিষদ গঠিত হবে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহ: নির্বাচনে ২৪টি রাজনৈতিক দল এবং বেশ কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ, পি.পি.পি, ন্যাপ, মুসলিম লীগ (তিন গ্রুপ), জামায়াত-ই- ইসলাম, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিপি ইত্যাদি। নির্বাচন হয় মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বনাম ভুট্টো। কোন দলই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়নি। পূর্ব বাংলার বামপন্থি দল ন্যাপ নির্বাচন বয়কট করে।
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ১৯৭০ : পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অধিবেশন
হয় ১৯৭০ সালের ৪ জুন। এতে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান, প্রচার সম্পাদক আব্দুল মোমিন, দপ্তর সম্পাদক মু. উল্লাহ তবে সহ-সভাপতি মুনসুর আলী ও মোশতাক ছিলেন।
নির্বাচনের প্রচারাভিযান : পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু রেডিও, টেলিভিশন জাতীয়বাদ ও আঞ্চলিক বৈষম্যকে কেন্দ্র করে ৬ দফার পক্ষে ‘গণভোট’ বলে প্রচারণা চালায়। আওয়ামী লীগের সাড়া জাগানো পোস্টার ছিল।
‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’
পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা, ভারত বিরোধিতা, সামরিক শক্তিবৃদ্ধি, কৃষি সংস্কার, অর্থনৈতিক
সাম্য ছিল পি. পি. পির প্রচারাভিযানের মূল বিষয়বস্তু। ভুট্টোর নির্বাচনি স্লোগান “ইসলাম হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র হচ্ছে আমাদের নীতি এবং সমাজতন্ত্র হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি।”
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল : ১৯৭০ সালের নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ভোটের হার ছিল ৫৫.০৯% এবং সমগ্র পাকিস্তানে ছিল ৫৭.৯৬%, জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের ৭৫.১০% এবং ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি লাভ করে। অবশিষ্ট ২ আসনের মধ্যে ১টি পান পি.ডি.পি নূরুল আমিন অপরটি স্বতন্ত্র পার্টির চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন আওয়ামী লীগ ৭০.৪৮% ভোট এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি
লাভ করে। অবশিষ্ট ১২টি আসনের মধ্যে পি. ডি. পি ২টি, ন্যাপ ১টি, জামায়াত ১টি, স্বতন্ত্র প্রার্থী ৮টি আসন পায় । জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনের সব কয়টি লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলে ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানি জাতীয় পরিষদে মোট ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮ আসনের মধ্যে পি. পি. পি. ৮৩টি, ন্যাপ ৬টি, মুসলিম লীগ কাইউম ৯টি, মুসলিম লীগ কাউন্সিল ৭টি, মুসলিম লীগ কনভেনশন ২টি, জামায়াত-ই-ইসলাম ৪টি, জমিয়াতে-ই- উলামা-ই-পাকিস্তান ৭টি, স্বতন্ত্র প্রার্থীগণ ১৪টি আসন লাভ করে :
১৯৭০ সালের নির্বাচনের তাৎপর্য : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটে শুধু আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষায় থাকে। এটির মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে যে আকাশচুম্বী ব্যবধান ছিল তাহাই সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হয়।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে আসন পায়নি। অতএব, পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা নেই। অপরদিকে, ভুট্টোর
পি.পি.পি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮টি আসন লাভ করলে পূর্ব পাকিস্তানে একটিও পায়নি। ফলে দুই পাকিস্তানে জাতি হিসেবে পাকিস্তানের বাস্তব কোন ভিত্তি নেই।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব : নিচে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
i. বাঙালি জাতীয়তাবাদ : নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয় হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের জয় ছিল মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই প্রকৃত জয়।
ii. ভৌগোলিক বিভক্তি : এ নির্বাচনে ভৌগোলিক বিভক্তি প্রকাশ পায়। কারণ আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে ও
পি. পি. পি পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসন পায়নি। ফলে এক দলের অন্য প্রদেশে কোন জনপ্রিয়তা নেই।
iii. ধর্মভিত্তি : আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা, ফলে এতে সকল ধর্মের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মতামত দেয়। অন্যদিকে, পি. পি. পির ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ফলে আওয়ামী লীগ, ভারত বন্ধুত্ব স্থাপন আর পি.
পি. পি ছিল ভারত বিদ্বেষ সৃষ্টি।
iv. একক জাতি : আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৭৫.১০% এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৭০.৪৮% ভোট লাভ করে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের মানুষ একটি একক ‘জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ।
v. আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন : আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে ৬ দফার উপর গণভোট বলে ঘোষণা করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনই ছিল নির্বাচনি অভিযানের মূলকথা।
vi. দাঁতভাঙা জবাব : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে বিভিন্নভাবে দমন, পীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার, শোষণ ও শাসন করে আসছে। বাঙালি জনগোষ্ঠী ৭০ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শোষক শ্রেণির শাসনের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নির্বাচনের পর পাকিস্তান ভাঙন ত্বরান্বিত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা শুরু করে। ইয়াহিয়া খানের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র পাকিস্তানের মৃত্যু অনিবার্য করে তোলে। ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যা বাঙালিদেরকে অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এভাবেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটে। এ নির্বাচনের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।