অথবা, ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুসারে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সংবিধান একটি জাতির দর্পণস্বরূপ। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে সৃষ্টি হয় জটিলতা। দীর্ঘ ৯ বছর পর পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন হয়। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে সংবিধান কার্যকর হয়। সংবিধানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার প্রভৃতিসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। প্রাদেশিক
স্বায়ত্তশাসন ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হলেও জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের উভয় প্রদেশকে সংবিধানের আওতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপমুক্ত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। সংবিধানে স্পষ্ট অক্ষরে বলা হয়নি এমন বা অনুল্লিখিত বিষয়সমূহ প্রাদেশিক সরকারের এক্তিয়ারে রাখা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র গঠন করা হয় এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করা হয়। নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. ফেডারেল তালিকা : পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করা ছিল একটি জটিল পদ্ধতি ও দুরূহ কাজ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ফেডারেল তালিকায় যেখানে ৫৯টি তালিকা ছিল ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তা কমিয়ে ৩০টি করা হয়। প্রাদেশিক তালিকায় ১৯৩৫ এর ৫৪টি তালিকার জায়গায় ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ৯৪টি করা হয় এবং সহ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৯টি তালিকা। যদিও মনে হয় প্রাদেশিক তালিকার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তালিকা৷ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ফেডারেল তালিকায় যে ৩০টি তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলো হচ্ছে কোনো দেশের মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যুদ্ধ, মুদ্রা, সামরিক বাহিনীর পূর্ত কাম্য প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত শিল্প পারমাণবিক শক্তি ও তার উৎপাদনের বিষয়গুলো ইত্যাদি ছিল
ফেডারেল তালিকাভুক্ত। সে সময় দেশের বার্ষিক বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ ছিল প্রতিরক্ষা খাতে। দেখা যায় যে, কেন্দ্র তালিকায় দেশের সিংহভাগ আর্থিক বরাদ্দ কেন্দ্রের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে, প্রাদেশিক সরকারের কাছে থাকে সামাজিক কল্যাণ, কৃষি প্রমুখ।
২. গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস কেন্দ্রের হাতে : রাজস্ব খাতের বড় বড় উৎস যেমন- বহিঃশুল্ক, আবগারি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, আয়ব্যয় কর, ক্রয়বিক্রয় কর, নৌ ও বিমান বন্দর টারমিনাল কর, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর
কর ইত্যাদি কেন্দ্রের হাতে রাখা হয়। ফলে দেখা যায় যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল নামে মাত্র, গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলো কেন্দ্রের হাতে ছিল।
৩. প্রদেশের আয় : প্রদেশের হাতে যে রাজস্ব উৎস রাখা হয় তার তালিকা দীর্ঘ কিন্তু তা থেকে আয় হতো কম। আবার দেখা যায় যে, যে আয় যেমন খাজনা, ক্রয়বিক্রয়ের স্ট্যাম্প, শুল্ক ইত্যাদি প্রদেশের হাতে রাখা হয়। দেশের অভ্যন্ত রীণ ও বাহির হতে ঋণ সংগ্রহের ক্ষমতা কেন্দ্র সরকারের উপর রাখা হয়। কাজেই ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে যে
স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয় তা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
৪. আইন প্রণয়ন আইন প্রণয়ের ক্ষেত্রে প্রদেশের উপর কেন্দ্রের যৌথ তালিকা থেকে কেন্দ্র ও প্রদেশ উভয়ই আইন প্রণয়ন করতে পারত। কিন্তু প্রাদেশিক আইন পরিষদ কোনো আইন যদি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিপন্থি হতো তাহলে প্রাদেশিক আইন বাতিল বলে গণ্য হতো। বিশেষ বিশেষ বিষয়ে প্রাদেশিক আইন যদি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন না পেতো
তাহলে তা বৈধ বলে গণ্য হতো না।
৫. বহিঃআক্রমণ বিশৃঙ্খলা দমন : যদি প্রদেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে এ গোলযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করবে কেন্দ্র সরকার। ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পেলেও কেন্দ্র সরকার নানা অজুহাতে প্রদেশগুলোতে অহেতুক হস্তক্ষেপ করতো।
মূল্যায়ন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয় তা মূলত নানাবিধ কারণে সীমাবদ্ধ ছিল। মূল ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট। কেন্দ্র সরকার ইচ্ছা করলেই নানা অজুহাতে প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতাকে খর্ব করতে পারত ও হস্তক্ষেপ করতো। ফলে প্রকৃত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়নি। সংবিধানে ক্ষমতা কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের নিকট বণ্টন করা হলেও কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ছিল অযাচিত। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের ক্ষমতা থাকায় যেকোনো সময় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার ক্ষমতাও কেন্দ্র সরকারের নিকট ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকবৃন্দ সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থ বিবেচনা করে শাসন কার্য পরিচালনা করতো। ফলে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন লাভ করেনি ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে।