অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশে অভ্যুদয়ের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরিধি বাঙালির জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশের যে অভ্যুদয় তা একদিনে হয়নি; তেমনি সহজলভ্য ছিল না। সুদীর্ঘদিনের ত্যাগের ফসল হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। ৯ মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধি : ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি ছিল উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টি থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধি। নিচে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধি আলোচনা করা হলো। যথা :
১. বঙ্গভঙ্গ : ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল যা একটি স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব করতে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিল ।
২. লাহোর প্রস্তাব : বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে লাহোর প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাহোর প্রস্তাবে যে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা বলা হয় তা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। লাহোর প্রস্তাবে ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে। যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সাংস্কৃতিক ঐক্য : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাঙালি জাতির ছিল অভিন্ন সংস্কৃতি। ভাষা, আচারআচরণ মূল্যবোধ ছিল অভিন্ন। ফলে জাতীয়তাবোধ ছিল সুদৃঢ়। এ জাতীয়তাবোধ দুর্বল করতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন শুরু করে। কিন্তু বাঙালি জাতি তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট ছিল।
৪. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : বাঙালি জাতির রয়েছে সুদীর্ঘ দিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বাঙালির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের জন্ম দেয়। অতঃপর দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে অভিহিত করে। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখে যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ধর্মভিত্তিক চেতনা : পাকিস্তান সৃষ্টি হয় মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান! কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল উদারপন্থি। তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ধর্মের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির উপর গুরুত্বারোপ করে। যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
৬. পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র কাঠামো : পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বৈষম্যের বীজ নিহিত ছিল। শাসকরা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের উপর প্রতিক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। উন্নয়নের পরিবর্তে দীর্ঘদিন ধরে দমন করে রাখার যে কৌশল অবলম্বন করে; যা গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
৭. অর্থনৈতিক বৈষম্য : অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পূর্ব পাকিস্তানে ৬০% রাজস্ব আদায়ে হতো অথচ এর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের ২৫-৩০% ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে যা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাঙনের অন্যতম কারণ।
৮. শিল্পপ্রতিষ্ঠান : বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো পূর্ব পাকিস্তান হতে এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের ৪৩% মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির ক্ষেত্রে তিন-চতুর্থাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে।
৯. পাকিস্তানের সংবিধানে বৈষম্য : দীর্ঘ নয় বছর পরে যে সংবিধান তৈরি হয় পাকিস্তানে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানির জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি এবং সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর সামরিক শাসন জারি প্রভৃতি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ ও শাসনের এক নীল নকশা।
১০. একুশ দফা, ছয়দফা, এগারো দফা : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে তার প্রতি বাংলার জনগণ সমর্থন দিলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা সে জনমতের গুরুত্ব দেয়নি। ছয়দফা ছিল বাঙালির প্রাণের দাবি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দেশরক্ষার অধিকারের রূপরেখা। যা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে গণ্য করে। ছয়দফা হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তির সনদ।
১১. আইয়ূব খানের পতন : আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসন ছিল পাকিস্তান ভাঙনের অন্যতম কারণ। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর অবিচার, অন্যায় ও নির্যাতন শুরু করে। এর ফলে বাংলার জনগণ গণআন্দোলন শুরু করে। গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।
১২. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এতে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার দাবি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিল না ফলে তারা বিভিন্ন অজুহাতে অধিবেশন স্থগিত করে।
১৩. ২৫ মার্চ, ১৯৭১ : ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো সাধারণ জনগণের আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমনের জন্য সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয় নিরীহ বাঙালির উপর। শুরু করে গণহত্যা। এর বিরুদ্ধে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে । শুরু হয় বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তির লড়াই তথা মুক্তিযুদ্ধ।
১৪. ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ : পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ভারতের সহায়তায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় লাভ করে। এ যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহিদ হয় এবং ৬ লক্ষের কাছাকাছি [মুনতাসীর মামুন] নারী নির্যাতিত হয়। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞ এতই ব্যাপক ছিল যে, তা অনেক বড় বড় যুদ্ধের ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পরিধি ছিল এক সংগ্রামী ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অর্জন করে স্বাধীনতা। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।