অথবা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ কী কী? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পাকিস্তানের কাঠামোর অধীনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সংগ্রাম করে এসেছে বাঙালি। এরই ধারাবাহিকতায় সূচিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা
আন্দোলন, গঠিত হয় ‘৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ‘৬২ সালের শিক্ষা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচনের বিজয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘৭১ সালের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যায় বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনাবলি ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনাবলি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলোর মধ্যে ১৯৫২, ‘৫৪, ‘৬২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০ ও ‘৭১ সালের ঘটনাবলি ধারাবাহিকভাবে এখানে তুলে ধরা হলো :
১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন : ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ আন্দোলন বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার ভিত্তি সুদৃঢ় করে। মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার যে উদ্যোগ গৃহীত হয় তার বিরোধিতা করে বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে গড়ে উঠা বাঙালিদের যে আন্দোলন, তাই ভাষা.আন্দোলন।
২. ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন : পাকিস্তান রাষ্ট্রে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় অনুষ্ঠিত এ প্রথম নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হাতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এ ফলাফল ছিল পাকিস্তানি শাসন শোষণ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ব্যালট
বিপ্লব। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের কারণে বাঙালিদের এ বিজয় স্থায়ী হয়নি।
৩. ‘৬২ এর ছাত্র আন্দোলন : আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল অনেক আগেই ৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য তাদেরকে আরো ক্ষুব্ধ করে। ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে উল্লিখিত ছাত্র আন্দোলন শুরু করার চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। কিন্তু এর পূর্বেই সুযোগ এসে যায়। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার আকস্মিকভাবে করাচিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের সংবাদ দাবানলের মতো দ্রুত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
৪. ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন : ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কনভেনশনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং পাকিস্তানি শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে ছয়দফাভিত্তিক এক তুমুল আন্দোলন পরিচালিত হয় সারা পূর্ব বাংলায়।
৫. আগরতলা মামলা ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান : ছয়দফা কর্মসূচিভিত্তিক বাঙালির জাতীয় জাগরণকে নস্যাৎ করতে জেনারেল আইয়ুব খান আগরতলা মামলার আশ্রয় নেন। কিন্তু এট
ি শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। লৌহমানব আইয়ুবের পতন ঘটে।
৬. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন ছিল। এ নির্বাচনের ফলাফল ছিল বাঙালির জাতীয় উত্থানের পরিচয়বাহী। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে না নেওয়ায় পাকিস্তান তার ক্রান্তিকালে উপনীত হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু
পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় জাতীয় পরিষদের ১৬০টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের ৭৫-১০% লাভ করে। তাছাড়া ৭টি মহিলা আসনের সবকটি লাভ করে আওয়ামী লীগ। সর্বমোট ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অপরদিকে, পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের কারণে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
৭. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এ সংগ্রামের মহানায়ক। ‘৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি তাঁর নেতৃত্ব ও নির্দেশে পরিচালিত বাঙালির সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চ (১৯৭১) প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালিদের জাতীয় মুক্তির চূড়ান্ত পর্বের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে। ৭ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথকে সুনিশ্চিত করেছিল। তাঁর ভাষণের কিছু অংশ ছিল এ রকম “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। …… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট হিসেবে বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। এগুলোর মধ্যে উক্ত ঘটনাবলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিশেষভাবে এবং এগুলো সর্বশেষ গুরুত্ব বহন করে। মূলত ১৯৪৭ এর পর ‘৫২, ‘৫৪, ‘৬২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০ পেরিয়েই ‘৭১ সালে ছিল সম্পৃক্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম সংগঠিত হয় এক রক্তিম আত্মত্যাগী চেতনায়।