বাংলাদেশের অভ্যুদয় কোন আকস্মিক ঘটনা নয়; এটা ক্রমবিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ”- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাংলাদেশে তথা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি মাইলফলক। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির
পর পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের উপর যে বৈষম্যের দাবানল জ্বলতে থাকে তার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামের সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
১. রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন : ভাষা বিতর্ক নিয়ে প্রথম থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, যা রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হানে। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালে ভাষা
আন্দোলন সংগঠিত করে।
২. আইয়ুব সরকারের প্রতি ক্ষোভ : আইয়ুব শাসন ও তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি বাঙালিদের চরম অসন্তোষের প্রকাশ ঘটে। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আইয়ুব সরকারের নিশ্চিত পরাজয় ঘটত বলে অনেকে মনে করেন। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী K. B. Sayeed বলেছেন, “Even government party workers conceded after the president election that government had won the election, but lost the people.”
৩. আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসন : ১৯৫৮ সালের আইয়ুব সরকারের গৃহীত সামরিক শাসনের ফলে বাঙালি জাতির প্রতি শোষণের মাত্রা চরমে পৌঁছে। বাংলার জনগণ আইয়ুব সরকারের এ একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে পারেনি। যার ফলে তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
৪. মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৫৯ সালে আইয়ুব সরকারের Basic Democracy (মৌলিক গণতন্ত্র) এর নামে এককেন্দ্রিক সরকার সৃষ্টির লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির সংহতিকে বিনষ্ট করা। কিন্তু সেটা হিতে বিপরীত হয়।
৫. ১৯৬৬ এর ছয়দফা : বাঙালি জাতি স্বাধিকার চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলনে, যার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন শেখ মুজিব। মূলত বাংলাদেশ আবির্ভাবের বীজ নিহিত ছিল ছয়দফা দাবিতে।
৬. পাকিস্তানের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক কাঠামো : ভাষা ছাড়াও দুই পাকিস্তানের পৃথক ধরনের সংস্কৃতি এবং উভয় অংশের মধ্যে হাজার মাইল দূরত্বের প্রেক্ষিতে প্রথম থেকেই রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে আর্থসামাজিক কাঠামোতে ছিল ভারসাম্যের অভাব। এ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করে বাংলার জনগণ।
৭. নানা কালাকানুন : আইয়ুব সরকারের আমলে বিভিন্ন কালাকানুন যেমন- প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স (১৯৬৩), বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ১৯৬৪ ইত্যাদি পাস করা হয়। এসব কালাকানুনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে।
৮. পাকিস্তানের বিভিন্ন বৈষম্য নীতি : পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে।
৯. ৭০’র নির্বাচন : ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাবের মূলে ৭০’র সাধারণ নির্বাচন ছিল একটি মাইলফলক স্বরূপ। কেননা এ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির পরাজয় ঘটলে পাকিস্তান জাতি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তাছাড়া নির্বাচনের পরাজয়ের পর ইয়াহিয়া খান কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। যার ফলে রাজনৈতিক আবহাওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনুকূলে প্রবাহিত হয়।
১০. অবশেষে ‘৭১ এর মুক্তির সংগ্রাম : কালের বিবর্তে ‘৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির মাঠের ফসলস্বরূপ। যার প্রথম বীজবপন হয় ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৯৭১ স ালের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ছিল বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত। এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, বরং এটা ছিল মূলত ক্রমবিবর্তনের ফল। ১৯৫২, ৬৬, ৬৯, ৭০ প্রভৃতি রাজনৈতিক ঘটনাবলি তথা পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের প্রতি একাধিক বৈষম্যের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।