অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে নেতৃত্বের পরিবর্তনের স্বরূপ উল্লেখ কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রকৃতি তুলে ধর।
অথবা, স্থানীয় রাজনীতিতে সনাতনী নেতৃত্বের পরিবর্তনের স্বরূপ বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে নেতৃত্বের পরিবর্তনের স্বরূপ সম্পর্কে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : যে কোনো সমাজেই নেতৃত্বের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেতৃত্ব ছাড়া কোনো সমাজ চলতে পারে না। গ্রাম নেতৃত্বই গ্রাম পরিচালনায় ভূমিকা রাখতো। গ্রামীণ শান্তি শৃঙ্খলা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, বিচার শালিস সবকিছু ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।
স্থানীয় রাজনীতিতে/গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে সনাতনী নেতৃত্বের পরিবর্তনের স্বরূপ : ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নেতৃত্বে যুগ যুগ ধরে গোষ্ঠীপতি বা মাতব্বরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। বৃহৎ গোষ্ঠীর দলপতি সমগ্র গ্রামের নেতা হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুত গ্রামীণ সমাজে গোষ্ঠীপতি বা মাতব্বরের ভূমিকার মধ্য দিয়েই অপ্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে এক সময় অপরিবর্তনীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সমাজ বিদ্যমান ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে গ্রামীণ সমাজে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। রাজনীতি এবং অর্থনীতি তথা উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনে সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এসব পরিবর্তনই মূলত ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নেতৃত্বের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। নিম্নে সনাতনী নেতৃত্বের পতনের বিভিন্ন কারণ তুলে ধরা হলো :
১. শিক্ষা ও সচেতনতার বিকাশ : ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই ভারতীয় এবং বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষার বিস্তার শুরু হয়। শিক্ষাবিস্তারের সাথে সাথে নানা দিক দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের সচেতনতাবোধ তৈরি হয়েছে । জ্ঞান, যুক্তি এবং ন্যায়ের চর্চা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ জীবনে ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের বিকল্প তৈরি হতে থাকে। শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ তথা পেশাজীবী শ্রেণি ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের শূন্য স্থান পূরণ করে।
২. কৃষি বহির্ভূত পেশার সম্প্রসারণ : গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার হার বেড়ে যাবার ফলে কৃষি বহির্ভূত পেশার সম্প্রসারণ ঘটেছে। কৃষি বহির্ভূত পেশার সম্প্রসারণ ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক, ব্যাংকের কর্মকর্তা/ কর্মচারী, উপজেলা সদরের অন্য কোনো চাকরিজীবী, চৌকিদার, দফাদার প্রমুখ পেশাজীবী মানুষ গ্রামীণ নেতৃত্বে ভূমিকা রাখতে পারেন ।
৩. নগরায়ণের প্রভাব : নগরায়ণের ফলে গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষ শহরে চলে যায়। শিক্ষা ও পেশাগত কারণে যারা শহরে অবস্থান করে গ্রামের উপর তাদের এক ধরনের নতুন প্রভাব তৈরি হয়। এতে সনাতন নেতৃত্বের প্রভাব খানিকটা খর্ব হয়।
৪. গণতন্ত্রের বিকাশ : গ্রামের ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব ভেঙে যাওয়ার মূলে গণতন্ত্রের বিকাশ অন্যতম প্রধান কারণ। গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের ফলে ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা ও আনুগত্য কমে গেছে।
৫. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ : শিক্ষা সচেতনতা ইত্যাদির ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গ্রামীণ সনাতন নেতৃত্বের প্রভাব কমে যাচ্ছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজে স্থানীয় নেতৃত্বের সনাতনী ধারা পরিবর্তনের জন্য সামাজিক বিধিবিধানগুলোর পরিবর্তনই দায়ী। গ্রামীণ জনপদে শ্রেণি স্বার্থ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় সনাতনী নেতৃত্বে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে।