সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে সমাজকর্মীদের ভূমিকা আলোচনা কর ।

অথবা, সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে সমাজকর্মীদের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, পরিবেশ সংরক্ষণে সমাজকর্মীদের অবদান ব্যাখ্যা কর।
অথবা, প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমাজকর্মীদের ভূমিকা সবিস্তারে উল্লেখ কর।
উত্তর ভূমিকা :
প্রতিবেশ হলো প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যে বিদ্যমান আন্তঃসম্পর্কের অধ্যয়ন। বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ, স্থান, সবকিছুর একটি সুষ্ঠু প্রতিবেশ থাকে। এ প্রতিবেশ নষ্ট হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আর একটি প্রতিবেশের সমস্যা অন্য প্রতিবেশ তথা সমগ্র পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমাজকর্মীরা মূলত বিভিন্ন মনোসামাজিক,
আর্থসামাজিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে। এসব সমস্যা মূলত ব্যক্তি ও তার পরিবেশের আন্তঃসম্পর্কের সমস্যা তথা প্রতিবেশগত সমস্যা হতে সৃষ্টি হয়। সুতরাং, সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করার জন্য সমাজকর্মীদেরকে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে সমাজকর্মীর ভূমিকা : পরিবেশের সাথে ব্যক্তির বিদ্যমান আন্তঃসম্পর্ক তথা প্রতিবেশজনিত সমস্যা থেকেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়, যা সমাধানে সমাজকর্মী কাজ করে। সুতরাং, সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সমাজকর্মীকে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে কাজ করতে হয়। নিম্নে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে সমাজকর্মীর ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণগত সমস্যার সমাধান : সমাজকর্মী বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণগত সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে মূলত ব্যক্তি ও তার পরিবেশে আন্তঃসম্পর্ককে উন্নত করে। এর ফলে ব্যক্তি উন্নত জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়।
২. আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধান : দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, বেকারত্ব, যৌতুক ও কুসংস্কার প্রভৃতি সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে মূলত প্রতিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এভাবে প্রতিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাজকর্মী সুষ্ঠু প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে ।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ : সমাজকর্মীরা অসহায়, দুঃস্থ, বিকলাঙ্গ, অক্ষম, দুর্দশাগ্রস্ত, বৃদ্ধ প্রভৃতি মানুষের
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত থাকে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে ।
৪. স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিচালনা : সমাজকর্মীরা বিভিন্ন জনসমষ্টিতে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করতে পারে। তারা এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশগত সমস্যা নিরসনে সমষ্টির লোকজনকে স্বউদ্যোগে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, যা সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।
৫. তথ্যসংগ্রহ ও সচেতনতা সৃষ্টি : সমাজকর্মী তথ্যসংগ্রহ ও তা বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, রেডিও, টিভি, আলোচনা সভা ও সেমিনার প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রচারের মাধ্যমে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে ।
৬. NGO কর্মী হিসেবে ভূমিকা পালন : সমাজকর্মীরা বিভিন্ন NGO কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশগত সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে প্রতিবেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। আর্সেনিক সমস্যা মোকাবিলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং বেকারত্ব, যৌতুক, অশিক্ষা, কুসংস্কার দূরীকরণে ভূমিকা রেখে মূলত তারা সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে।
৭. নতুন প্রযুক্তির প্রচলন : বেকারত্ব, দরিদ্রতা প্রভৃতি সমস্যা নিরসনে সমাজকর্মীরা কাজ করে। এক্ষেত্রে তারা অনেক সময় বিভিন্ন নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রচলন ঘটায়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী Client দেরকে প্রতিবেশগত ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারে। এর ফলে জনগণ প্রতিবেশগত ঝুঁকি ব্যতিরেকে তাদের আর্থিক উন্নতির মাধ্যমে সুষ্ঠু প্রতিবেশ
নিশ্চিত করতে পারে।
৮. সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি : সমাজকর্মীরা বিভিন্ন প্রতিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে মানুষকে সচেতন করে
তোলার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
৯. পরিবেশ আইন প্রণয়ন : সমাজকর্মীরা পরিবেশ বিষয়ক আইন প্রণয়নের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। আবার এ আইন প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে আইন প্রণয়নে সহায়তা করতে পারেন।
১০. জাতীয় প্রতিবেশ নীতি প্রণয়ন : সমাজকর্মীরা সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য একটি জাতীয় নীতি প্রণয়নের জন্য তাদের বিভিন্ন পেশাগত অবস্থান থেকে ‘প্রেসার গ্রুফ’ হিসেবে কাজ করতে পারে, জনগণকে সাথে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে এবং নীতি প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতে পারে। এভাবে সমাজকর্মীরা সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে।
১১. জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ : মূলত প্রতিবেশগত সমস্যার কারণেই ব্যক্তি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। সমাজকর্মীরা এসব সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কাজ করে। সুতরাং, এক্ষেত্রে সমাজকর্মীরা সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১২. টেকসই উন্নয়ন : সমাজকর্মীরা উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘টেকসই উন্নয়ন’ এর দর্শনে উদ্বুদ্ধ, যা সম্পদের পরিমিত ও যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে কোন প্রতিবেশ তথা পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যতিরেকে যথার্থ ও সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করে। সুতরাং, টেকসই উন্নয়ন কর্মী হিসেবে সমাজকর্মীরা সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৩. বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন : সমাজকর্মীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন বা স্বেচ্ছামূলকভাবে প্রতিবেশের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রতিবেশগত সচেতনতা আনয়ন ও সুষ্ঠু প্রতিবেশ বান্ধব অবকাঠামো গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। যা সুষ্ঠু প্রতিবেশ নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে পারে।
১৪. মেডিকেল সোশাল ওয়ার্কার : আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে বিভিন্ন রোগের যথার্থ চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার থাকে। এক্ষেত্রে তারা রোগীদেরকে বিভিন্ন প্রতিবেশগত বিষয়ে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে রোগের যথার্থ চিকিৎসা নিশ্চিত করে । আবার এ প্রতিবেশগত সচেতনতা সুষ্ঠু প্রতিবেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে ।
১৫. গ্রাম উন্নয়ন : সমাজকর্মীরা পৃথিবীর সকল দেশেই গ্রাম উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে তারা টেকসই উন্নয়নের ধারণা ব্যবহার এবং প্রতিবেশগত বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে সুষ্ঠু প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে।
১৬. শহর উন্নয়ন : প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের পিছনে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও শহরায়ণ সব থেকে জোরালো ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীরা বিভিন্ন পরিবেশ তথা প্রতিবেশগত বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা ও বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে সুষ্ঠু শহুরে প্রতিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রতিবেশ হলো প্রাণী ও তার পরিবেশের মধ্যে বিদ্যমান আন্তঃসম্পর্কের অধ্যয়ন। এ আন্তঃসম্পর্কে কোন সমস্যা দেখা দিলে প্রাণী বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয়। সমাজকর্মী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবীয় সমস্যা সমাধানে কাজ করে। এসব সমস্যার সমাধানে তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যথার্থ প্রতিবেশ নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখে। তাদের এ ভূমিকা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।