সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং আমার বাঁশি সৃষ্টির কৌশলে অতএব, দোষ বাঁশিরও নয়, সুরেরও নয়, দোষ আমার, যে বাজায়।”— ব্যাখ্যা কর।

উৎস : উদ্ধৃত অংশটুকু সুরস্রষ্টা প্রাবন্ধিক কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গ : বিশ্বস্রষ্টা কবির মনে কথা এবং সুর সৃষ্টির শক্তি দিয়েছেন, কবি শুধু তাঁর নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র এ কথাটিই এখানে গুরুত্ব পেয়েছে।
বিশ্লেষণ : সত্যের প্রকাশ কখনো নিরুদ্ধ হয় না। কোন না কোনদিন, কারো না কারো কণ্ঠে তা প্রতিধ্বনিত হবেই। ন্যায় ও সত্যের প্রতি নিষ্ঠা আর আবেগ সৃষ্টি হয় মনে। তারপর তা বাঁশিরূপী কণ্ঠে এসে স্থিত হয় সুর সৃষ্টির জন্য। নানা কৌশলে বিচিত্র ভঙ্গিমায় সে সুর কবি প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে দেন। সে সুর সঞ্চারিত হয়, লালিত হয়। সচেতনতা সৃষ্টি করে মানুষের প্রাণে। মানুষ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে, প্রতিবাদ করে, বিদ্রোহ করে। তারা স্বাধিকার ফিরে পেতে চায় স্বাধীনতা চায়, সমস্ত সমস্যা জটিলতা, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি চায়। সুরের মোহে অন্ধ না হয়ে কবির সে সুরের স্পন্দনে নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হতে চায়। পরাধীন দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করার শক্তি যুগিয়েছেন যিনি, তিনি মহাসৈনিক তিনি মূল বাদ্যকার, তিনিই বিশ্বস্রষ্টা। তিনি কবির কণ্ঠে যখন যে সুর তুলে দিয়েছেন কবি তাই বাজিয়েছেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই কবি এগিয়েছেন। অনলবর্ষী বক্তব্য রেখেছেন লিখেছেন মানুষের আত্মোপলব্ধির জন্য। তিনি কোন অন্যায় করেন নি। মিথ্যা বলেন নি। গানে গানে, সুরে সুরে তিনি পরাধীনতার মোহ ভঙ্গ করেছেন, দেশবাসীকে অসত্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সঞ্জীবনী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কাজেই তাঁর কোন দোষ নেই। রাজশক্তি ক্রোধান্ধ হয়ে তাঁকে রাজ কারাগারে, অন্যায়ভাবে শাস্তি দিচ্ছে। তা বলে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়নি। শাসন নিরুদ্ধ বাণী আরো অনেকের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে।
মন্তব্য: কবির বাণী এবং সুরের ইন্দ্রজাল রুদ্ধ করার জন্য রাজার রাজদণ্ডের প্রয়োগ রাজার কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। কেননা, কবি জানেন, কবির কোন দোষ নেই। দোষ তাঁর যিনি কবির কণ্ঠে বীণা বাজান।