সুফিবাদ কাকে বলে? সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : সুফিবাদ ইসলামের মতো একটি প্রাচীনতম দর্শন। সুফি সাধকেরা জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হলো আল্লাহর দীদার লাভ করা। সুফিবাদের উন্মেষ ঘটে ইসলামের অভ্যুদয়ের সাথে সাথেই। সুফি দর্শনে প্রথম গুরু বা সাধক হিসেবে ধরা হয় হযরত মুহাম্মদ (স.) কে। তার নিকট থেকেই সাহাবাবৃন্দ সুফিদর্শনের শিক্ষা লাভ করেন। সুফিগণের জীবনে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সুফিবাদকে অন্যান্য মতবাদ থেকে আলাদা করে।
→ সুফিবাদ : সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সংগে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মূলকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহকে জানার এবং আকাঙ্ক্ষা মানুষে চিরন্তন। স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কে কে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে সুফিবাদ বলে।
১. হযরত ইমাম গাজালি (র.) এর মতে, “আল্লাহ্ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ বলে।”
২. আল কুশাইরী এর মতে, “বাহ্য ও অন্তর জীবনের বিশুদ্ধতাই সুফিবাদ।” সুতরাং, সুফিবাদ হচ্ছে এমন একটি দর্শন যেখানে আর্থিব জীবনের সুখ ও সম্পদের প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত করে অনাড়ম্বর ও নির্লোভ জীবনাচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
→ সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য : সুফি দর্শনে সুফিগণের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ
করা যায়। নিচে সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. ধর্মীয় বিশ্বাস : ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুফিদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। তারা মনে করে যে, সুফিদর্শনের প্রথম গুরু ছিলেন হযরত
মহাম্মদ (স.)। তারা মহানবী (স.) এর কার্যাবলিকে অনুসরণ করে ধর্মীয় কাজ পরিচালনা করে থাকে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসকে তারা মানব আচারণের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।
২. আল্লাহর একত্ব : মানুষের জীবনে সফলতা ও পরকালীন মুক্তি একমাত্র ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব। আর ইসলাম হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করে। তাদের মতে, “আল্লাহ্ ছাড়া কোনো সত্তা নাই।” এজন্য তারা আল্লাহকে পাবার আশায় পার্থিব জীবনের সুখ ত্যাগ করে আল্লাহর প্রেমে মশগুল হয়ে থাকে।
৩. মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন : মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তারা সমাজের বিভিন্ন অনৈতিক কাজকর্ম থেকে বিরত
থাকে এমনকি তারা জগতের মোহ মায়া ত্যাগ করে নিজকে সর্বস্ব করে আল্লাহর পথে জীবন পরিচালিত করে। তারা মহান আল্লাহ্ এর
সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নামাজ, রোজা, জিকির ইত্যাদি করে।
৪. মানবতার মূর্ত প্রতীক : সুফি বা পীররা ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক স্বরূপ। অধিকারহারা ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল । সুফিরা সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করে এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ, কষ্ট তারা অনুভব করে। সুফিদের ছায়াতলে এসে অনেক সাধারণ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছিল |
সুফিরা তাদের প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে এসব মানুষের মন জয় করেছিলেন এবং তাদেরকে বাঁচার জন্য প্রেরণা দিয়েছিলেন।
৫. শিক্ষা বিস্তার : সুফি সাধকরা শুধুমাত্র ইসলাম প্রচার করে যান নি’। তারা তাদের ইসলামের বাণীকে সর্বাধিকে ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষা বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তারা নিজেরা জ্ঞানের চর্চা করতেন এবং অন্যদের জ্ঞানের চর্চা করার জন্য উপদেশ দিতেন। আর জ্ঞানের চর্চার জন্য তারা খানকাহ বা মাদ্রাসা
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তারকে তারা ধর্মীয় কর্তব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন।
৬. আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত : সুফিরা বলেন যে, আল্লাহর সাথে মিলনই মনের জীবনের সার্থকতা মানব জীবনের পরিপূর্ণতা। তাদের মতে, মানুষের আত্মা আল্লাহ্ হতেই নিঃসৃত হয়েছে। আল্লাহ্ তার নিজ রুহ মানবের মধ্যে প্রদান করেছেন এবং এই রুহই প্রকৃত মানব, যা আল্লার সাথে সম্পর্কযুক্ত, আল্লার সাথে সুফিদের যে মিলনের কথা বলা হয়েছে তা মূলত আধ্যাত্মিক মিলন।
৭. সা’ মা : সুফিদের একটি অন্যন্য বৈশিষ্ট্য হলো সা’মা বা আল্লাহমূলক সংগীত। সুফিরা ধর্ম সংগীত, গজল, কাওয়ালী ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সা’মা’ কে সুফিগণ আত্মার খাদ্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৮. আত্মার অমরত্ব : সুফিরা আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, পূর্ণ মানবের আত্মা সম্পূর্ণরূপে বিশ্ব আত্মা আল্লাহর
মধ্যে বিলুপ্ত বা সমাহিত হয়ে অমরত্ব লাভ করবে। কেননা প্রকৃত সুফি বেহেশত, দোযখ সম্পর্কিত স্তরের উর্ধ্বে বাস করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফি দর্শন একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। প্রেম হলো এই দর্শনের মূল। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সুফিদের প্রেম। এই প্রেমের মাধ্যমের সুফি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে এবং এক সময় আল্লাহময় হয়ে ওঠে.