অথবা, সুফি দর্শনে স্তরসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সুফি সাধনার পথসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদের চারটি স্তর ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সুফি দর্শনের স্তরসমূহ সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লিখ ।
উত্তর৷ ভূমিকা : আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আল্লাহর প্রেম ও ধ্যানের উপর প্রতিষ্ঠিত যে মতবাদ তা ইসলামে সুফিবাদ নামে পরিচিত। সুফিবাদের প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা স্বজ্ঞার মাধ্যমে আল্লাহর তত্ত্বজ্ঞান লাভে সচেষ্ট। বিভিন্ন তরিকার সুফিরা তাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই একে অপর থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। সুফিরা তাত্ত্বিকতার চেয়ে ব্যবহারিক দিকের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। সুফিরা যে শিক্ষাগ্রহণ করে তা অত্যন্ত নিগূঢ়, যা অন্তর থেকে অন্তরে অতিক্রান্ত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। সুতরাং সুফিবাদ একটা ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়।
সুফিবাদ : সুফিবাদ হচ্ছে মানব মনের একটি ধারণা। প্রতিটি সমাজে কিছুসংখ্যক লোকের মাঝে সুফি ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। সুফিবাদ এক প্রকার জীবনদর্শন। সুফিদের ধারণা, জগৎ প্রকৃতই এক মন্দ বাসস্থান যা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি বা বিকাশের অন্তরায়। তারা এ জগতের সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং তাদের দ্বারা কৃত।পাপসমূহের জন্য অতীতকে অনুশোচনার সাথে স্মরণ করেন। আধ্যাত্মিক উন্নতিই তাদের লক্ষ্য।
সুফিবাদের চারটি স্তর : সুফিবাদ ইসলামের বাতেনি বা অভ্যন্তরীণ দিককে গুরুত্ব সহকারে বিচার করে। | মানুষের প্রাণ ছাড়া যেমন দেহ অসার, তেমনি ধর্মের সভ্যন্তরীণ ভক্তির দিক ছাড়া ধর্মীয় আচার এবং অনুষ্ঠান মূল্যহীন, সুফি শিক্ষার জন্য কয়েকটি স্তর অতিক্রম করতে হয় একজন সুফি সাধককে। সেগুলো হলো :
১. শরিয়ত ।
২. তরিকত।
৩. মারেফত।
৪. হকিকত
১. শরিয়ত : একজন সুফির জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ। সুফি পথ-পরিক্রমার প্রথম পথ হলো শরিয়ত। শরিয়ত বলতে বুঝায় ইসলামি জীবন বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন। ইসলামি শরিয়তের সকল হুকুম আহকাম সকলের জন্য অবশ্যই পালনীয়। কারো জন্য এখানে ছাড় নেই। ইসলামে যত নবী ও রাসূল এ দুনিয়াতে
এসেছেন তারা সকলেই শরিয়ত পালন করেছেন এবং কিভাবে তা পালন করতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছে। পবিত্র আল কুরআনে ইরশাদ হয়, “অতঃপর আমি তোমাকে দ্বীনের শরিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিলাম।
২. তরিকত : তরিকত বলতে বুঝায় নির্দিষ্ট পথ। শরিয়তের বিভিন্ন বিধানাবলি পালনের ফলে সুফির কাছে যে বিষয়টি উন্মোচিত হয় তা হলো তরিকত। তরিকত শরিয়তের পরের ধাপ। এটি শরিয়তের চেয়ে উন্নত ও উচ্চতর। এ স্তরে সুফি তার সাধনার দিকনির্দেশনার জন্য পীর বা মুরিদের কাছে সাহায্য কামনা করেন। এ পর্যায়ে পীরের নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মুরিদ পালন করতে প্রস্তুত হয়। পীর মুরিদের সামর্থ্যানুযায়ী ওজিফা বা করণীয় নির্ধারণ করেছেন। সে অনুযায়ী মুরিদ তার সাধনা চালিয়ে যেতে থাকে।
৩. মারেফত : মারেফত বলতে বুঝায় আধ্যাত্মিক জ্যোতি। এ এমন এক জ্যোতি যা অজ্ঞান ও অসত্যের অন্ধকারকে আলোকিত করে। একে বর্ণনার মাধ্যমে বুঝান সম্ভব নয়, বরং অনুভবেই বুঝা সম্ভব। মারফতের জ্ঞানের মাধ্যমে একজন সুফি সাধক আধ্যাত্মিক জ্যোতি লাভ করেন। এ জ্যোতির ফলে তার কলব বা অন্তকরণ আলোকিত হয়। তিনি তখন বস্তুর নিগূঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন। সৃষ্টি রহস্যের কালোপর্দা তার কাছ হতে অপসারিত হয়। মারেফতের আলোয় আলোকিত হয়ে সুফি আল্লাহতে নিবেদিত ও উৎসর্গকৃত হয়। পবিত্র আল কুরআনে ইরশাদ হয়, ‘আমার ধ্যান, উপাসনা, জীবন মরণ সমস্তই বিশ্বনিয়ন্তা, আল্লাহর জন্য উৎসর্গকৃত’ (সূরা ৭, আয়াত ১৬৩)। এ পর্যায়ে সাধক পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর ধ্যান চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন।
৪. হকিকত : মারেফতের পরবর্তী উচ্চতর স্তর হলো হকিকত। হকিকত হলো এমন
একটি বিষয় যেটির মাধ্যমে সুফি প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। হকিকতের স্তরে সুফি সত্য উপলব্ধি করেন। আল্লাহর অপার করুণার উপরই এ উপলব্ধি নির্ভর করে। এ কথা অবশ্যই সত্য যে, আল্লাহর অসীম রহমত ছাড়া কেউ তার জ্ঞানের বিন্দুমাত্রও অবহিত হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, বাহ্যিকভাবে ধর্মীয় আচার আচরণ পালনের মাধ্যমে হকিকতের জ্ঞান উপলব্ধি সম্ভব নয়। হৃদয় বা অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে হকিকতের বা প্রকৃত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব। হকিকতের জ্ঞান হলো আল্লাহ হলেন পরম সত্য এবং বাকি সব তার শক্তির প্রকাশ মাত্র। একজন সুফি ফানা ও বাকার স্তর অতিক্রম করে হকিকতের জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফিবাদের অনুশীলন ক্রমস্তরে বিভক্ত। সেগুলো হলো শরিয়ত, তরিকত, মারেফত ও হকিকত। অর্থাৎ সুফিরা প্রথমে শরিয়ত পালন করবে। শরিয়তকে সঠিকভাবে পালনের জন্য সে তরিকার অনুসন্ধান করবে। এর মাধ্যমে লাভ করবে মারেফতের জ্ঞান। এ জ্ঞানের মাধ্যমে সুফি আল্লাহ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করতে পারবে।