অথবা, কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী মতের পরিচয় দাও।
অথবা, সাম্য ও মানবতার কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের অভিমত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : কাজী নজরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ একজন সুপরিচিত কবি হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে নয়।
একাডেমিক দার্শনিকদের নামের যে দীর্ঘ তালিকা তাতে তাঁর নাম নেই। তবে তাঁর দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাব্য, গানে, উপন্যাসে ও নাটকে। নজরুল নিজেকে আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতার ব্যাপক পরিসরে নিয়ে
গেছেন তাঁর অবদানের দ্বারা। ইংরেজ সাহিত্যিক S.T. Colridge বলেছেন, “No man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosoper.” অর্থাৎ, যিনি একজন বড় মাপের কবি তিনি একই সাথে একজন প্রগাঢ় দার্শনিক না হয়ে পারেন না। আর এ অর্থে কাজী নজরুল ইসলামকে একজন দার্শনিক বলা যায়।
কাজী নজরুল ইসলামের মানবতাবাদ : বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি দর্শনের এক কিংবদন্তির নাম। তিনি এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও বিশ্ব দরবারে এক মহৎ স্থান দখল করে আছেন। নজরুল দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে উপলব্ধি করেছেন সর্বহারা শ্রেণির দুঃখদুর্দশা। তাই তিনি সর্বত্র সর্বহারার জয়গান গেয়েছেন। তিনি তাঁর কবিতা, সাহিত্য ও গানে মানবপ্রেমের ছবি তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত মানবতাকামী মানুষ । নিম্নে তাঁর মানবতাবাদের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো :
নজরুলের সার্বিক মানবতাবাদ : নজরুল শুধু কোনো বিশেষ শ্রেণির মানবপ্রেমের কথা বলেননি, তিনি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য প্রেমের কথা বলেছেন। নজরুলকে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা, সামাজিক বন্ধন, এমনকি ধর্মীয় বন্ধনও আটকে রাখতে পারেনি। তাঁর ভাষায়, “আমি এদেশে এ সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এদেশেরই এবং এ সমাজের নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কেউ বলে আমি মুসলমান, কেউ বলে কাফের, আমি বলি দু’টির কোনটাই নই ।
আমি শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করার চেষ্টা করেছি।” উদার মানসিকতাসম্পন্ন মানবতাবাদী দার্শনিকদের পক্ষে শুধু এরকম কথা বলা সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী দার্শনিক নজরুল ইসলাম নিচুতা, ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সকল প্রকার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে দর্শন চর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি সকল মানুষকে এক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি সকল বিশ্বকে একটি দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। ফলে তিনি হয়েছিলেন বিশ্বনাগরিক।
নজরুলের বিদ্রোহী মানবতাবাদ : নজরুল ছিলেন একজন বিদ্রোহী মানুষ। তাঁর অনেক লেখায় আমরা খুঁজে পাই তাঁর বিদ্রোহী মানসিকতা। তাই তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেও পরিচিত। নজরুলের বিদ্রোহ নতুন যুগের
মানবতাবোধের সাথে সম্পৃক্ত। মানবসমাজের অবিচার ও অসাম্য থেকে শুরু করে স্রষ্টার নিরঙ্কুশ শাসনাধিপত্য পর্যন্ত তাঁর বিদ্রোহের সীমা বিস্তৃত। নজরুল বলেছেন,
“জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক জাগো শ্রমিক, জাগো নারী।” নজরুল অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধনে মুখর হয়ে উঠলেন,
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ চিহ্ন
আমি স্রষ্টা সূদন, শোক তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।”
নজরুল নিজেই বলেছেন, আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বিদ্রোহের মাধ্যমে মানুষের সর্বাত্মক মুক্তি চান। শ্রমিক, কৃষক, সর্বহারা মানুষকে তিনি দিতে চেয়েছিলেন অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষার অধিকার।
নজরুলের ধর্মীয় মানবতাবাদ : নজরুল ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সকল ধর্মের, সকল মানুষের মুক্তির দিশারি। নজরুল ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে তাঁর মানবীয় সত্তাকে বলি দেননি। তবে নজরুল একজন
মুসলিম হিসেবে অবশ্যই তাঁর ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বিচরণ করেছেন। তাঁর লেখনিতে তিনি প্রথমে মানুষ, তারপর মুসলিম
হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মত দেন। তিনি ধর্মের নৈতিক দিক যা সর্বজনীন মানবতাবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, তারই উপাসক। তাঁর লেখা,
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেখানে তালা চালা হাতুড়ি শাবল চালা।”
তাইতো বলা যায়, তিনি কোন শ্রেণির নয়; তিনি সকল মানুষের।
কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী মত : কাজী নজরুল ইসলাম যে সময়ে তার সাহিত্য চর্চা শুরু করেন সে সময় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনাধীনে। পরাধীনতার গ্লানি তাঁকে বিদ্রোহী চেতনায় উপনীত হতে সহায়তা করে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে এবং ব্রিটিশ দখলমুক্ত হতে হলে সমগ্র জনসাধারণের ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাইতো তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় সাম্যবাদের জয়গান গেয়েছেন। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর ‘যৌবনের গান’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন, “আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের, আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি, ধর্ম, কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাহাদের যৌবন, তাহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর।” তিনি মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে প্রভেদ স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, হিন্দু-মুসলিম, অভিজাত-অপজাত, প্রভু-ভৃত্য প্রভৃতি বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে মানবজাতির অখণ্ডতাকে অস্বীকার করা
অমার্জনীয় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর ‘সাম্যের গান’ কবিতায় বলেছেন,
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।”
নজরুল ছিলেন একজন পুরোদস্তুর অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দার্শনিক। তাইতো তিনি উপমহাদেশের হিন্দু-
মুসলিম বিভেদকে মেনে নিতে পারেননি। হিন্দু ও মুসলিম জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করতে তাঁর প্রয়াস ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায়। তিনি বলেছেন,
“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোরমার।”
এ প্রসঙ্গে ‘পুতুলের বিয়ে’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
“মোর!, এক বৃন্তে দু’টি ফুল হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমরা সত্য ও সুন্দরের পূজারী। এ কবিকে একজন বিশিষ্ট দার্শনিক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি; যিনি মানুষের কথা, জীবনের কথা, জগতের কথা, স্রষ্টার কথা, নীতির কথা, প্রেমের কথা, দেশের কথা আমাদের শুনিয়েছেন। তাঁর মানবসেবা ও সাম্যবাদী চেতনা যে শুধু ব্যক্তিমানুষের,
মর্যাদা সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়েছে তাই নয়; বরং বলা যায়, সমাজ, রাষ্ট্র তথা একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত। আর এ দৃষ্টান্তপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।