অথবা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাব্যবস্থা কী ভূমিকা পালন করে থাকে? বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানবসমাজ মাত্রেরই একটি মৌলিক কার্যপ্রক্রিয়া হলো শিক্ষা। প্রকৃত প্রস্তাবে শিক্ষা হলো এক ধরনের বিশেষ সংস্কারসাধন। সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যক্তিমানুষের স্বয়ংক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের এক সর্বাঙ্গীণ ধরতে হলো শিক্ষা। তাছাড়া শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপূর্ণ পদ্ধতি। শিক্ষা শুধুমাত্র একটি পদ্ধতি নয়। সর্বাত্মক প্রিয়া হলো এক ধরনের স্বয়ং শিক্ষা। এছাড়া শিক্ষা মানুষের মৌলিক অন্যতম। শিক্ষা মানুষকে অস্ক্রতা ও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক তোলে। আর এ সুশিক্ষিত জাতি বা চাহিদাসমূহের মধ্যে হিসেবে গড়ে সম্প্রদায়ই পারে দেশ ও সমাজকে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে। তাই একটি দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো পরিবর্তনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিহার্য।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা : সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষা হলো অন্যতম নিয়ামক। সমাজের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা সমাজের সদস্যদের আচার আচরণ নির্দিষ্ট একটি রূপ লাভ করে ও নিয়ন্ত্রিত হয়। বস্তুত ব্যক্তিমানুষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এভাবে শিক্ষা সামগ্রিকভাবে সমাজব্যবস্থাকেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এজন্য বলা যায় যে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকার সামাজিক তাৎপর্য অপরিসীম। নিম্নে আরও বিস্তারিতভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে : সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষা হলো অন্যতম নিয়ামক। সাম্প্রতিককালে সকল সভ্য দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সামাজিক তাৎপর্যের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। সুতরাং বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সমাজের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার উপর অল্পবিস্তর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শিক্ষাব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এখন অন্যতম সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়।
২. সামাজিক দুষ্ক্রিয়তা রোধে : সমাজে প্রচলিত প্রথা প্রতিষ্ঠান, আচার-বিচার, ন্যায়নীতি, স্বীকৃত মূল্যবোধ, সংক্ষেপে জীবনধারার যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। তার ফলে সমাজের সদস্যদের কার্যকলাপ ও আচার ব্যবহার এবং চিন্তাচেতনা সমাজজীবন ও তার কৃষ্টিধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সামঞ্জস্য সাধিত হয়ে থাকে। তার ফলে সামাজিক বিধিব্যবস্থার সাথে সমাজবাসীদের কোন রকম বিরোধ বা অসামঞ্জস্যের আশংকার অবসান ঘটে। অর্থাৎ সামাজিক দুষ্ক্রিয়তা বা বিধি ভঙ্গের আশংকা অপসৃত হয় ।
৩. সামাজিক ঐক্য ও সংহতি : শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হয়। কারণ সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শিক্ষা সুস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মানবিকতাবোধকে ব্যক্তি মানসে জাগরিত করে। আবার শিক্ষাব্যবস্থার কল্যাণেই সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ ও নাগরিকদের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যুক্তিবাদী ও বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন হয়। এ কারণে শিক্ষিত মানুষ সহজেই স্বভাবজাত প্রবৃত্তি ও আবেগ উত্তেজনাকে বশীভূত রতে পারে এবং বিচার ও বুদ্ধিকে প্রয়োগ করতে পারে ।
৪. স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণের সৃষ্টি : সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা হলো পরোক্ষ, প্রত্যক্ষ নয়। শিক্ষার এভাবে মানুষ সমাজসচেতন, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হয়। এ কারণেই শিক্ষিত মানুষ ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণ চিন
্তা তথা সাম্প্রদায়িকতার হীন প্রভাবকে অতিক্রম করতে পারে। শিক্ষা নবীনদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সামাজিক চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করে। এতে করে তাদের পক্ষে নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়। তাছাড়া শিক্ষা সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের ভিতর থেকে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধ্যানধারণা ও সামাজিক কুসংস্কারসমূহ দূরীভূত করে। প্রকৃত প্রস্তাবে যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত ব্যক্তি নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণের সৃষ্টি হয় ।
আধুনিককালে শিল্পসভ্যতার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। আর এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। প্রাক শিল্পযুগের সমাজব্যবস্থায় সমাজের জীবনধারাগত বৈশিষ্ট্যের সাথে শিক্ষাব্যবস্থার সামঞ্জস্য বর্তমান ছিল। সুতরাং সামাজিক নিয়ামক হিসেবে তখন শিক্ষার ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে অর্থবহ ও কার্যকরী। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ ছিল না। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ব্যাপক বিস্তারের ফলে সমাজব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের আবির্ভাব ঘটেছে। শিল্পসভ্যতার বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজজীবনে কৃষ্টিগত ধারা বা সামাজিক উত্তরাধিকারের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাধান্য। এ রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজের স্বীকৃত মূল্যবোধ, সামাজিক আদর্শ ও ন্যায়নীতির ধারণা প্রভৃতি গুরুত্বহীন প্রতিপন্ন হয়।
৬. গণমাধ্যমের বিরূপ প্রভাব : সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষার নিয়ামক ক্ষমতা গণসংযোগ মাধ্যমসমূহেও হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানকালের সমাজ সভ্যতা হলো বাণিজ্যিক সমাজ সভ্যতা। আধুনিককালের এ সমাজ সভ্যতায় গণসংযোগের মাধ্যমগুলো ব্যক্তিমানুষের মনঃপ্রকৃতি বা চিন্তাচেতনার উপর এক ধরনের স্থায়ী প্রকৃতির প্রভাব প্রতিক্রিয়া কায়েম করে। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রচারমাধ্যমগুলোর সাথে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার নীতি ও আদর্শগত অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এ অসঙ্গতির ফলশ্রুতি হিসেবে শিক্ষার্থীদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা অমূলক নয় এবং এ ধরনের বিভ্রান্তির কারণে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এভাবে গণসংযোগের মাধ্যমসমূহ বর্তমানে সামাজিক নিয়ামক হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকার উপর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমাজে ব্যক্তিগত আদর্শকে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন সমধিক। শিক্ষা সামাজিক মানুষকে নানারকম কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দান করে এবং যুক্তিসংগত উপায়ে সুনির্দিষ্ট পথে চালনা করতে সহায়তা করে। সমাজবিজ্ঞানিগণ শিক্ষাকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হিসেবে মনে করেন। শিক্ষা মানব মনের সংকীর্ণতা, জড়তা ও কলুষতা দূর করতে সাহায্য করে। শিক্ষার মাধ্যমে পারস্পরিক মূল্যবোধ বুঝতে চেষ্টা করে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে শৃঙ্খলতার মাঝে ফিরিয়ে আনার বাহন হিসেবে শিক্ষা কাজ করে। সুতরাং সমাজের সকল দিক বিবেচনা করে বলা যায় যে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার ভূমিকা অত্যধিক।