অথবা, সামাজিক গোষ্ঠীর স্তরবিন্যাস আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গোষ্ঠীর ধরন সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিন্যাস আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিবভাগসমূহের বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানবসমাজের বাইরে স্বাভাবিক মানুষের বসবাস অসম্ভব। এ যে সামাজিকতা তার সূত্রপাত প্রথমত পরিবারে। কালক্রমে ব্যক্তি বৃহত্তর সামাজিক জীবনে প্রবিষ্ট হয়। নানা সংস্থা ও সংগঠনের সাথে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনে যুক্ত হয়। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এসব সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে বিকশিত হতে থাকে এবং সাংস্কৃতিক পূর্ণতা পায়। ফলে
গোষ্ঠী হলো একই উদ্দেশ্য সাধনে একটি সংগঠন। সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা সমগ্র মানবজীবন জুড়ে। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত সামাজিক গোষ্ঠী হলো মানুষের বিচিত্রমুখী সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের আধারস্বরূপ। সে ক্ষেত্রে সমাজ ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলো অভিন্ন নয়। সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ (Classification of group) : নিম্নে সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো :
ক. আন্তর্গোষ্ঠী ও বহির্গোষ্ঠী (In-group and out-group) : সামনার (W. G. Sumner) তাঁর ‘Folkways’ শীর্ষক গ্রন্থে গোষ্ঠীকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : আর্ন্তগোষ্ঠী ও বহির্গোষ্ঠী। আন্তর্গোষ্ঠীর প্রতি সদস্যদের গভীর মায়া ও সম্পর্ক নিবিড় থাকে। তাদের মধ্যে ‘আমরা বোধ’ বিদ্যমান থাকে। যেমন- হিন্দু ধর্মে একজন হিন্দু ব্যক্তিকে অন্য হিন্দ ব্যক্তিরা আন্তর্গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু অন্য ধর্মের কাউকে বহির্গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। যেসব গোষ্ঠীর প্রতি আমাদের মনোভাব ঔদাসীন্যের বা শত্রুতার সেসব গোষ্ঠীই হলো বৰ্হিগোষ্ঠী।
খ. ঐচ্ছিক গোষ্ঠী ও অনৈচ্ছিক গোষ্ঠী (Voluntary and involuntary group): চার্লস এ এলউড (Charles A. Ellwood) তাঁর ‘Psychology of Human Society’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “The voluntary group include political party, trade unions, youth associations, religious, cultural associations and involuntary groups include the group such as family, city, the state, community; caste, race etc. ” গোষ্ঠীর সদস্য হওয়া বা না হওয়া ইচ্ছাধীন কিনা তার ভিত্তিতে এ দু’ধরনের গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। ঐচ্ছিক গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছায় গোষ্ঠীর সদস্যপদ গ্রহণ করে। অন্যদিকে, অনৈচ্ছিক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন : রাষ্ট্র নামক
গোষ্ঠীর সদস্য হওয়া ব্যক্তির নয় রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।
গ. উল্লম্ব গোষ্ঠী ও সমতল গোষ্ঠী (Vertical and horizontal group) : সরোকিন (P. A. Sorokin) গোষ্ঠীকে এ দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। উল্লম্ব সামাজিক গোষ্ঠীতে সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। যেমন : মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ক্যাবিনেট মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের নিয়ে।
অন্যদিকে, সমতল গোষ্ঠীর সদস্যরা সমপর্যায়ভুক্ত। উদাহরণ হিসেবে শ্রেণির কথা বলা যায়। শ্রেণির মধ্যে ব্যক্তির পদমর্যাদা একই ধরনের।
ঘ. স্থায়ী গোষ্ঠী ও অল্পকাল স্থায়ী গোষ্ঠী (Permanent and transitory group) : স্থায়িত্বের প্রেক্ষিতে এ দু’ধরনের গোষ্ঠী লক্ষ করা যায়। নামকরণ থেকেই বুঝা যায় পরিবার, জাতি ও শ্রেণি হলো স্থায়ী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, অল্পকাল স্থায়ী গোষ্ঠীর উদাহরণ হলো ভিড় (Crowd) ও শ্রোতামণ্ডলী (Audience) প্রভৃতি।
ঙ. ছোট গোষ্ঠী ও বড় গোষ্ঠী (Small group and large group): জর্জ সিমেল এ দুই শ্রেণির গোষ্ঠীর কথা বলেছেন। আয়তনই হলো এ শ্রেণি বিভাজনের ভিত্তি। এটি যুগল বা ত্রয়ী বা অন্যান্য ছোট গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত।
যেমন : স্বামী-স্ত্রীর পরিবার বা স্বামী-স্ত্রী এক সন্তানের পরিবার। অন্যদিকে, বড় গোষ্ঠী হলো জাতি গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল বা একটা জাতি বা অন্যান্য বড় গোষ্ঠী।
চ. বিধিবদ্ধ গোষ্ঠী ও অবিধিবদ্ধ গোষ্ঠী (Formal and informal group): নিয়মকানুন ও কর্মপদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের গোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে। বিধিবদ্ধ গোষ্ঠীর কর্ম ও আচা
র-আচরণ হলো নিয়মকানুন ও বিধিবদ্ধ।
যেমন : সরকারি অফিস। অন্যদিকে, চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে। যেমন : পাঠচক্র গোষ্ঠী। group এর সদস্যদের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
ছ. জনসম্প্রদায় ও সংঘ (Community and association) : একে অপরের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে টোনিজ (Tonnies) এ দুই গোষ্ঠীর কথা বলেছেন। টোনিজ তাঁর ‘Community and Association’ গ্রন্থে
বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। টোনিজের মতে, “Community is characterised by intimate’ private and exclusive living together.” অর্থাৎ, ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ স্বতন্ত্র সম্পর্কের জালে জড়িত হলো সম্প্রদায়।
অন্যদিকে, “Association is defined as ‘public life’, as something which is purposefully entered .” অর্থনৈতিক স্বার্থের উপর গড়ে উঠা সম্পর্কের ভিত্তিতে এ ধরনের গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়।
জ. বংশগতিক ও সমাবিষ্ট গোষ্ঠী (Genetic and congregate group) : ‘Principles of Sociology’ গ্রন্থে গিডিংস (Giddings) এ ধরনের গোষ্ঠীর সূত্রপাত করেছেন। বংশগত গোষ্ঠী হলো, পরিবার যেখানে ব্যক্তি মানুষ বংশগতিক সূত্রে । পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। বিপরীতে সমাবিষ্ট গোষ্ঠী হলো, ঐচ্ছিক গোষ্ঠী যেখানে স্বেচ্ছায় মানুষ মিলিত হয়।
ঝ. প্রাথমিক গোষ্ঠী ও গৌণ গোষ্ঠী (Primary and secondary group) : প্রাথমিক গোষ্ঠী হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সংগঠন যার সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকে। এ সম্পর্কের স্বরূপ হলো গভীর ও নিবিড়। এ গোষ্ঠীর উদাহরণ হলো, পরিবার ও খেলার দল ইত্যাদি। গৌণ গোষ্ঠী হলো এমন গোষ্ঠী যা আকারে বৃহৎ ও উদ্দেশ্যযুক্ত। এ গোষ্ঠীর সাংগঠনিক বিষয় হলো প্রধান। উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলোর সাথে জড়িত কুলি (C. H. Cooly) যিনি গৌণ গোষ্ঠী সম্পর্কে তেমন কিছু বলেননি। উল্লিখিত গোষ্ঠী ছাড়াও আরো বেশকিছু গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা যায়। সেগুলো হলো :
১. সংঘটিত গোষ্ঠী ও অসংঘটিত গোষ্ঠী;
২. বৃহত্তর গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী;
৩. উন্মুক্ত গোষ্ঠী ও বদ্ধ গোষ্ঠী;
৪. স্বাধীন গোষ্ঠী ও নির্ভরশীল গোষ্ঠী এবং
৫. প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠী।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, সমাজবিজ্ঞানীগণ তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণি বিভাজন করেছেন। ফলে গোষ্ঠীর আলোচনা বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। সামাজিক গোষ্ঠীর এমন কোনো সংজ্ঞা নেই যা সকল সমাজবিজ্ঞানী দ্বারা স্বীকৃত বা গৃহীত ।