সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন উপাদান আলোচনা কর

সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন উপাদান আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণার নির্ধারকগুলো আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণার উপাদানসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণার নির্ধারকগুলো বিশ্লেষণ কর।

উত্তরা ভূমিকা : বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক বিজ্ঞানের মূল আলোচ্যবিষয় মানুষ ও তার আচরণ । ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞান নিজস্ব দৃষ্টিতে এসব নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা পরিচালনা করে। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বা সামাজিক প্রপঞ্চের প্রকৃতি উদ্ঘাটনের জন্য যেসব গবেষণা পরিচালনা করা হয় তাকে সামাজিক গবেষণা বলে। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের সমস্যা
নির্ধারণ ও সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। সামাজিক গবেষণার উপাদান : সামাজিক গবেষণা নিয়মতান্ত্রিক ও সময়ের ব্যাপার বিধায় নিম্নের
উপাদানগুলো গবেষণার ক্ষেত্রে দরকার। যথা :

১. তত্ত্ব (Theory),
২. সংজ্ঞা (Definition),
৩. অনুমান বা কল্পনা (Hypothesis) এবং
৪. প্রত্যয় (Concept),
৫. চলক (Variables),
৬. নৈতিকতা (Morality)

১. তত্ত্ব : বিজ্ঞানের উন্নতি তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। তত্ত্ব গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি এবং জ্ঞানকে সংক্ষিপ্ত করে। G.R. Adams and J. D. Scharanevelut বলেছেন, “Theory is an explanation for events a rational for why something occurred; it is the scientific explanation of a condition that has been observed.” অর্থাৎ, তত্ত্ব চূড়ান্ত বা স্থির নয়, এটি সাময়িক ও অপরিবর্তনীয়।

তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য : তত্ত্বের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। নিম্নে তা দেয়া হলো :

ক. তত্ত্বের কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই। তত্ত্ব বড় হতে পারে আবার ছোটও হতে পারে ।
খ. তত্ত্ব প্রচলিত জ্ঞানকে সংক্ষিপ্ত করে ।
গ. তত্ত্ব সাময়িক ও পরিবর্তনীয় ।
ঘ. এটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা সূত্রের বর্ণনা দেয়।
ঙ. এটি সহজসরল ভাষায় উপস্থাপিত হয় এবং
চ. এটি বাস্তব ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত I


বস্তুত যতবেশি সুসংঘবদ্ধ তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হবে গবেষণার ফলাফল তত বেশি উন্নত হবে।


২. প্রত্যয় বা ধারণা : প্রত্যয় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতির মৌলিক উপাদান । বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও পক্ষপাতহীনভাবে গবেষণা করতে হলে প্রত্যয় অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। গবেষণার প্রত্যয় বলতে কোনো বিষয়কে বর্ণনা করার মতো শব্দচয়কে বুঝায় । অর্থাৎ, একটি বিশেষ সামাজিক অবস্থা বর্ণনার জন্য যখন প্রতীকী শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয় তাকে প্রত্যয় বলা হয়।

৩. সংজ্ঞা : সংজ্ঞা সামাজিক গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । এর মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো বিষয়কে সহজ ও সুস্পষ্ট করা। গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো বিষয় বা শব্দ ব্যববহার করলে তার একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়, ফলে শব্দটি সহজবোধগম্য হয়। সংজ্ঞা নির্ধারণের সময় যেসব বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখা হয় তা হলো :
ক. কোনো বিষয় সম্পর্কে বেশি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে কি না ।
খ. কোনো বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ।
গ. প্রদত্ত সকল সংজ্ঞার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তুলনামূলক আলোচনা এবং
ঘ. সংজ্ঞায় ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা।
৪. চলক : মূলত চলক এমন এক ধরনের গুণ বা বৈশিষ্ট্য, যা একই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। সর্বাধিক সংবেদনশীল উপাদান হলো চলক, যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে পড়ে। নিম্নে সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত তুলে ধরা হলো :
Barry And Anderson এর ভাষায়, “চলক হলো পরস্পর বিভিন্ন গুণের সমাবেশ।”
চলক বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । প্রাথমিকভাবে চলক চার প্রকার। যথা :
ক. স্বাধীন চলক : যে চলক অন্য কোনো চলকের সাহায্য ছাড়া ঘটনার উপর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে তাকে স্বাধীন চলক বলে ।
খ. পরনির্ভরশীল চলক: যে চলক অন্যের সাহায্য ছাড়া কোনো ঘটনার উপর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না তাকে পরনির্ভরশীল চলক বলে ।
গ. অন্তর্বর্তী চলক : যে চলক স্বাধীন ও পরনির্ভরশীল চলকের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে তাকে অন্তর্বর্তী চলক বলে ।
ঘ. বাহ্যিক চলক : এটি গবেষণার উভয় চলকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করে। প্রকৃতিগত দিক থেকে চলক দুই প্রকার । যথা :
ক. গুণবাচক চলক : যে চলক গুণবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে তাকে গুণবাচক চলক বা Qalitive variable
বলে । যেমন- বিশ্বাস, অনুভূতি, প্রেম ও বিরহ ইত্যাদি ।

খ. পরিমাণবাচক চলক : যে চলক সংখ্যাতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে তাকে Quantitative variable বা পরিমাণবাচক চলক বলে । যেমন- ওজন, বয়স ও আয় ইত্যাদি। গতিপথের নিরিখে চলক দু’প্রকার । যথা :

১. বিচ্ছিন্ন চলক : যে চলক নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে সংখ্যার মান উল্লেখ করে এবং যার মধ্যে বিচ্ছেদ থাকে না, তাকে বিচ্ছিন্ন চলক বলে। যেমন-সন্তান ও পরিবার।


২. অবিচ্ছেদ্য চলক : যে চলক নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে সংখ্যার মান উল্লেখ করে তাকে অবিচ্ছেদ্য চলক বলে। যেমন- আয়, বয়স ইত্যাদি।


৫. কল্পনা বা পূর্বানুমান : প্রকল্প হলো পূর্ব অনুমান । সামাজিক গবেষণার পূর্বে গবেষক গবেষণার উপযোগী এক বা একাধিক কিছু অনুমান হিসেবে ধরতে পারেন।
প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য : প্রকল্পের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায় । যথা :
ক. প্রকল্পটি যুক্তিপূর্ণ হবে;
খ. বস্তুগত ভিত্তি থাকতে হবে;
গ. সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হতে হবে;
ঘ. সহজসরল এবং সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত হবে এবং
ঙ. যাচাই সাপেক্ষ হতে হবে।

প্রকল্পের ভূমিকা : সামাজিক গবেষণায় প্রকল্পের একাধিক ভূমিকা লক্ষ করা যায় । যেমন-
ক. অনুসন্ধান কাজে কি কি বিষয় অনুমোদন, গ্রহণ ও বর্জন করতে হবে তা প্রকল্পের উপস্থিতিতে নির্ধারণ করা যায় ।
খ. প্রকল্প গবেষককে বিশ্লেষণাধীন নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যেই মনোযোগী থাকতে সুযোগ দেয় ।
গ. যুগোপযোগী গবেষণা পদ্ধতি অবলম্বনে এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ প্রকল্প গবেষককে চালিত করে ।
ঘ. প্রকল্প গবেষণা কাজের সর্বক্ষেত্রে গবেষককে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয় ।

৬. নৈতিকতা : সামাজিক গবেষণার যত্রাপথ থেকে এটি মানুষের ভালোমন্দ বিবেচনা করেই কাজ করে।

J.Habermas তাঁর ‘Knowledge and Human Interest’ গ্রন্থে বলেছেন, “মানুষের স্বার্থ ছাড়া কোনো জ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়।” নৈতিকতাবাদীরা বলেছেন, মূল্যবোধ বাদে জ্ঞান অসম্ভব। অপরদিকে, বাস্তবাদীরা নিরপেক্ষ থাকার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে একথা বলা যায় যে, মূল্যবোধ ছাড়া জ্ঞান চর্চা সম্ভব নয় ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষেণার ক্ষেত্রে এর উপাদানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো গবেষণা কার্য এদের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়। এদের সঠিক ও নির্ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে গবেষণা কার্য ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব অন্যথায় তা বাধাপ্রাপ্ত হবে। সুতরাং, একজন গবেষকের এ উপাদানগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন।