অথবা, সামাজিকীকরণের চারটি নিয়ামকের নাম লিখ।
অথবা, সামাজিকীকরণের প্রধান চারটি উপাদানের বর্ণনা দাও।
অথবা, সামাজিকীকরণের উপাদানগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : সাধারণত সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা মানুষের সামাজিক প্রকৃতির বিকাশ ঘটে এবং যার দ্বারা মানুষ সামাজিক হয়ে উঠে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ শিক্ষা, পরিবার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে তোলে। অন্যভাবে বলা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি তার সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান বা খাপখাওয়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তা সম্পন্ন করে তাকে সামাজিকীকরণ বলা হয়ে থাকে। আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানী সি. এইচ. কুলী সর্বপ্রথম এ প্রত্যয়টির ব্যবহার করেন।
সামাজিকীকরণের উপাদান : নিম্নে সামাজিকীকরণের উপাদানসমূহের বিবরণ দেয়া হলো :
১. অনুকরণ : শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বড়দের কথা বলার ভঙ্গিসহ আশপাশের অনেক কিছুই অনুকরণ করতে শিখে। অনুকরণের মাধ্যমেই শিশুর সামাজিকীকরণের সূচনা হয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের কথা বলা, কাজ করার প্রচলিত রীতিগুলোও সে অনুকরণ করে। এভাবে শিশুরা বয়স্কদের কাছ থেকে নানারকমের আচার আচরণ শিখে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশু যখন প্রথম কথা বলতে শিখে, তখন দেখা যায়, শিশুর মাতাপিতা শিশুকে আম্মু কিংবা আব্বু বলে সম্বোধন করে এবং
শিশুটিও তা অনুকরণ করে মাকে আম্মু কিংবা পিতাকে আব্বু বলে ডাকে।
২. শিক্ষণ : শিক্ষণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কৃষ্টির উপাদান বিভিন্ন যুগে সঞ্চালিত হয়। শিশু তার পরিবার বা সমবয়সী কিংবা অন্য কারো কাছ থেকে তার স্বীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলো আয়ত্ত করে এবং সামাজিক হয়। মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মূলত ব্যক্তির শিক্ষণের ক্ষেত্রে চারটি বিষয় আবশ্যক। এ চারটি সম্পৃক্ত উপাদানের সাহায্যে মানুষের শিক্ষা সম্পন্ন হয়। যথা : i. তাড়না (Drive), ii. সংকেত (Cue), iii. প্রতিক্রিয়া (Response) ও iv. পুরস্কার (Reward)। Morgan King , “Learning can be defined as any relatively permanent change in
behaviour which occurs as a result of practice or experience.” [Introduction to Psychology] তাই Learning ছাড়া ব্যক্তির Socialization হয় না। মানুষ সামাজিক পরিবেশ থেকে শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক জীবে পরিণত হয়। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, কিভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশতে হবে, এককথায় কিভাবে সমাজের সাথে খাপখাইয়ে চলতে হবে এ সবকিছুই শিক্ষণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। মূলত সামাজিকীকরণ একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া।
৩. স্নেহ : স্নেহ হচ্ছে মানুষের দৈহিক, মানসিক সব দিকের সংবেদনশীল মানসিকতার প্রকাশ। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে স্নেহ, ভালোবাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। কেননা স্নেহ, ভালোবাসা ছাড়া সামাজিকীকরণ হতে পারে না। পরিবারের সাথে বেড়ে উঠার সাথে ব্যক্তির যে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে, সেটি নির্ধারিত হচ্ছে Effection এর
মাধ্যমে। শৈশবের পরিচিত প্রিয়জন যেমন- মা-বাবা, ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েই শিশু তাদের কাছ থেকে সামাজিক রীতিনীতিগুলো শিক্ষা করে। প্রবাদ আছে, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। তাই শুধু পরিবার পর্যায়েই নয়, জীবনের সর্বস্তরে স্নেহ, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সামাজিকীকরণ চলছে। তবে অনেক সময় স্নেহ, ভালোবাসার আধিক্য Anti-social হিসেবে কাজ করে।
- ক্রিয়া : Interaction হচ্ছে সম্পর্ক ও সহযোগিতা, যা বিনিময়ের মাধ্যমে গড়ে উঠে। পারস্পরিক সম্পর্ক ছাড়া সামাজিকীকরণ হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এজন্য বলা হয়, Man cannot live alone. পার্ক ও বার্জেসের মতে, “সামাজিক পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যম হলো সমাজের যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংবেদনবাহীঢ়ায়ু, অনুভূতি, ভাবধারা ও আদর্শের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যকর হয়।” সামাজিকীকরণের পারস্পরিক ক্রিয়া চার প্রকার। যথা :
i. প্রতিযোগিতা (Competition),
ii.দ্বন্দ্ব (Conflict),
iii. উপযোগ (Accommodation) ও
iv. সংমিশ্রণ (Assimilation)।
পারস্পরিক সম্পর্কটা আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। এ মিথস্ক্রিয়া আমাদের সহজাত প্রবৃত্তিকে জাগ্রত এবং নিয়ন্ত্রণ করে। মিথস্ক্রিয়ার ফলে মানুষ বা ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, সে সমাজের একটি অংশ। আমরা সমাজের মধ্যে যেভাবে পরস্পরের সাথে একত্রিত হচ্ছি সেটি সম্ভব হচ্ছে মূলত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে সামাজিকীকরণের উপাদানগুলো বিদ্যমান। পরিবারের সদস্যদেরকে অনুকরণের মাধ্যমে শিশুর সামাজিকীকরণ শুরু হয় এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অনুকরণ ও শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ চলতে থাকে। এজন্য সামাজিকীকরণকে একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া বলা হয়। মানবজীবনে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, আদেশ, অনুরোধ, উপদেশ এসব ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এসব দ্বারা ব্যক্তির সামাজিকীকরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্য বলা যায়, সামাজিকীকরণ সমাজের প্রতিটি অবয়বের সাথে যুক্ত।