সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল স্থাপনের পিছনে বেগম রোকেয়ার উদ্দেশ্য কি ছিল? তিনি এ উদ্দেশ্য অর্জনে কতটুকু সার্থক?

অথবা, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল কেন স্থাপন করেছিলেন? এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সার্থক?
উত্তর।৷ ভূমিকা :
যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে যে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা ও অবনতির কারণসমূহ পুঞ্জীভূত হয়ে প্রগতির পথ রুদ্ধ করেছিল, তা একমাত্র শিক্ষা প্রচারের দ্বারাই দূর করা যেতে পারে একথা বেগম রোকেয়ার কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই ছিল সত্য। অন্তর দিয়ে তিনি এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় এ সত্যও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়। দেশের বিপুল জনসমষ্টির অর্ধেক নারী। এ বিপুল জনসমষ্টিকে অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে জাতির উন্নতি সাধন অলীক কল্পনামাত্র। সমাজের উন্নতি সাধনের জন্য শুধু পুরুষ সম্প্রদায় নয়, নারী সম্প্রদায়েরও উন্নতি সাধন প্রয়োজন। একই সমাজদেহের দুই অপরিহার্য অঙ্গ নারী ও পুরুষ। পুরুষের বিকাশ যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন নারীর বিকাশ। তিনি এ সত্য অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে নারীসমাজের উন্নতি সাধনের জন্য স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
স্কুল স্থাপনের উদ্দেশ্য : নারী সম্প্রদায়ের অধঃপতিত অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। দেশ ও জাতির স্বার্থে মুসলমান নারীসমাজের জাগরণের জন্য তিনি শিক্ষা প্রচার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন। স্বজাতির সর্বাঙ্গীণ মুক্তি সম্পর্কে ইতিহাসের শিক্ষাকে সে যুগে মুসলমান পুরুষ সম্প্রদায় উপেক্ষা করলেও এ মহীয়সী মহিলা উপেক্ষা করতে পারে নি। পরিপূর্ণ ইতিহাস চেতনা নিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য
নারীসমাজকে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের পথ থেকে উদ্ধারের জন্য তিনি বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের সঙ্কট সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন। সমাজের নানাবিধ কুপ্রথা, কূপমণ্ডূকতা ও স্ত্রীশিক্ষাবিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। বাংলার মুসলমান নারীসমাজকে জাগরণের মন্ত্রে তিনিই সর্বপ্রথম উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সব্যসাচীর মত একাধারে শিক্ষা প্রচার ও শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার দ্বারা নারীমুক্তি সাধনের লক্ষ্যে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হয়েছিলেন। বেগম রোকেয়ার সারাজীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল, আর তা হলো নারীর কল্যাণ ও নারীর মানসিক মুক্তি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এ মুক্তির জন্য সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষার,কিন্তু তৎকালীন সমাজে মুসলিমদের জন্য কোন বালিকা বিদ্যালয় ছিল না। সে সময়ে মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া শেখার কোন সুব্যবস্থা ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েদের হিন্দু অথবা খ্রিস্টানদের স্কুলে পড়তে হতো। ফলে তারা হিন্দু না হয় খ্রিস্টান ভাবাপন্ন হয়ে পড়তেন। সে যুগে কলকাতার অতি আধুনিক মেয়েরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে যেভাবে আচার-আচরণে ও পোশাকে উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিত তা বেগম রোকেয়া মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, এমন অমুসলিম স্কুলে শিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলিম মেয়েরা লজ্জাশরমের ধার অতি অল্প ধারে। তারা যেভাবে পোশাক পরিচ্ছদ পড়ে পরপুরুষের সামনে বেপরোয়াভাবে বের হয়, তাতে শরিয়ত অনুযায়ী পর্দা রক্ষা হয় না। এ দুরবস্থার একমাত্র ঔষধ একটি আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়, যেখানে মেয়েরা আধুনিক জগতের অন্যান্য সম্প্রদায় এবং প্রদেশের লোকের সাথে তাল রেখে চলার মত উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে। এ উদ্দেশ্যেই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন। এ বিদ্যালয় স্থাপনের পিছনে সক্রিয় ছিল একটি আদর ্শ, একটি প্রেরণা।
সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপনের সফলতা : বাংলার মুসলমান নারীসমাজে শিক্ষাবিস্ত ণরের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপন করেন। স্কুলটি স্থাপন করার পর থেকে শান্তিপূর্ণভাবে এর কাজকর্ম তিনি পরিচালনা করতে পারেন নি। স্কুলটির অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য তাকে অশ্লীল গালিগালাজ, নিন্দা-বিদ্রূপ, অপমান ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। দেশের বড় বড় লোক তারাও প্রাণপণে এ স্কুলের বিরুদ্ধে শত্রুতা করেছেন। শত ঝঞ্ঝা, শিলাবৃষ্টি, অত্যাচার সহ্য করেও বেগম রোকেয়া সমাজের সামনে অতি উচ্চদরের এক অদ্বিতীয় আদর্শ বিদ্যালয় উপস্থিত করেছেন। স্কুলের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তাঁর অসীম অধ্যবসায় ও আস্ত রিক অনুপ্রেরণার ফলস্বরূপ ১৯৩০ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।অবরোধবন্দিনী মুসলমান মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করার মত প্রেরণা দান মোটেও সামান্য কাজ নয়। এ স্কুলের মাধ্যমে তিনি গৃহবন্দি মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তাদের ঘরের বাইরের জগতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন এবং অনেকক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। গৃহপ্রাচীরের অন্তরালে অবরুদ্ধ নারীকে বাইরের জগতে আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়, যা বেগম রোকেয়া স্কুলের মাধ্যমে করতে সক্ষম হয়েছেন। স্ত্রীশিক্ষা যে সমাজে ছিল একেবারে নিষিদ্ধ, সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধকার স্ত্রীশিক্ষা বিরোধী সমাজে স্ত্রীশিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছেন এ স্কুলের মাধ্যমে। বেগম রোকেয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে
গিয়ে সমাজের পশ্চাৎপদ মুসলমান নারীদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে টেনে বের করে এনেছেন আলোর জগতে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও এত মহান কাজে ব্রতী হয়েছেন। স্ত্রীশিক্ষাবিরোধী সমাজে স্কুল স্থাপন করে তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজের বিবেককে কিছুটা হলেও সাড়া জাগাতে পেড়েছেন।
পর্যালোচনা : কুম্ভকর্ণ বাঙালি মুসলমান সমাজের নিদ্রাভঙ্গ করতে না পারলেও বেগম রোকেয়া তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। শিক্ষাদীক্ষা বঞ্চিত অবরোধবন্দিনী মুসলমান নারীসমাজের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল অপরিসীম। এ অসহায়দের জন্য তার অন্তর মথিত করে আতক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছিল। নারী কল্যাণ ও নারীমুক্তির মুখ্য উদ্দেশ্যেই তাঁর আজীবনের কার্যকলাপ পরিচালিত হয়েছিল। মুসলিম নারীসমাজের মুক্তি শুধুমাত্র শিক্ষাবিস্তারের দ্বারা যে সম্ভবপর এ বিশ্বাস তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হয়েছিল অর্জিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কিত কার্যক্রমের আদর্শ থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হন নি। এ মহান আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্যই তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপন করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য অনেকাংশে সার্থক হয়েছে। তিনি তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন, স্ত্রীশিক্ষাবিরোধী সমাজে কিছুটা হলেও সাড়া জাগিয়েছেন। তাদের বিবেক কিছুটা হলেও জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই তাঁর স্কুল প্রতিষ্ঠার আসল সার্থকতা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলার নারী জাগরণের ইতিহাসে যার নাম সবার আগে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় সে পুণ্যময়ী মহীয়সী নারী হলেন বেগম রোকেয়া। বাংলার নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। বাংলার কূপমণ্ডূক মুসলমান নারীসমাজকে তিনিই সর্বপ্রথম মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। তিনিই প্রথম মুক্তিপথে বাংলার মুসলমান নারীসমাজকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্ লস স্কুলের নাম আজও স্মরণীয়। এ স্কুলই প্রথম মুসলমান নারীদের শিক্ষার পক্ষে
পরিচালিত করে। তাই মুসলমান নারীসমাজের শিক্ষার আলোর দিশারী হিসেবে সাখাওয়াত মেমেরিয়াল স্কুলের নাম সবার আগে স্মরণীয়। এ স্কুলের অবদান অনস্বীকার্য। তাই বলা যায়, বেগম রোকেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য অনেকাংশে সার্থক।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87/