বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিল তা বর্ণনা কর।

অথবা, বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন সেগুলো কিভাবে মোকাবিলা করেছেন তা আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিণী। তাঁর সমস্ত জীবনের আন্তরিক সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি।নারীসমাজের দুরবস্থা ও অধঃপতনের সঠিক কারণ চিহ্নিত করে তিনি দেখেছেন শিক্ষা ছাড়া নারীর মুক্তি সম্ভব নয়। নারীর দুরবস্থার একমাত্র প্রতিকার যে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার সে সম্পর্কে রোকেয়ার মনের বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। সমাজের
পশ্চাৎপদতা, কূপমণ্ডূকতা ও প্রচলিত কুসংস্কারগুলো দুরীকরণের জন্য প্রয়োজন স্ত্রীশিক্ষা। অবচ তৎকালীন সমাজ ছিল প্রধানত স্ত্রীশিক্ষাবিরোধী। সমাজের স্বার্থে নারীসমাজকে শিক্ষাদান করা দরকার। কারণ তাদের শিক্ষা ছাড়া সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসম্ভব। তাই নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের লক্ষ্যে শিক্ষাবিস্তার আন্দোলনে ব্র হয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন এ শিক্ষাবিস্তার তথা নারী জাগরণের কর্মকাতে। নারীমুক্তি তার সারাজীবনের স্বপ্ন। কোম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তার করতে গিয়ে নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন।
নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. পারিবারিক প্রভাব : সেকালে অন্যান্য পরিবারের ন্যায় বেগম রোকেয়ার পরিবারে লেখাপড়া শেখার পরেও ছিল নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। পর্দার নামে অবরোধের দরজা ছিল কঠোর। তাদের পরিবারে কুরআন শরীফ ছাড়া অন্য কোন লেখাপড়া ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করেও বেগম রোকেয়া লেখাপড়া শিখেছেন। যদিওবা ইতিহাস সাক্ষী,স্কুল, কলেজ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন তথাপি সে যুগে শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে মুসলমান নারীসমাজের জাগরণে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবারে তিনি তাঁর এক ভাই এবং তাঁর স্বামীর সাহায্য পেয়েছেন কিন্তু আর কারও কোন সাহায্য পান নি। তাঁর শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মনোভাব তেমন ভালো ছিল না। অবশ্য তাঁর এক বোন তাকে এ বিষয়ে অনেকটা সাহায্য করেছেন।
২. সামাজিক অবস্থা : সে সময় ছিল এক অন্ধকার যুগ। নারীরা সে যুগে ছিল গৃহপ্রাচীরের অন্তরালে অবরুদ্ধ।মুসলিম সমাজ ছিল নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। অশিক্ষা, অজ্ঞানতা ও কূপমণ্ডূকতার অপ্রতিহত প্রভাব। মেয়েদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। সামান্য শিক্ষার কোন সুযোগ ছিল না। উপরন্তু পর্দাপ্রথার নামে কঠোর অবরোধ প্রথা চালু ছিল। এরূপ বৈরি পরিবেশে নারী জাগরণ তথা নারী শিক্ষার কথা চিন্তাও করা যায় না, কিন্তু এসব সামাজিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে মনে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বেগম রোকেয়া তাঁর শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। সর্বপ্রকার সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মসী ধারণ করে তিনি আপসহীন সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।
৩. সপত্নী, কন্যা ও জামাতার বিরোধিতা : স্বামীর অকাল মৃত্যুতে স্বামীসান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য ও সেই সাথে শিক্ষা প্রচারের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষায় বেগম রোকেয়া প্রথমে ভাগলপুরে মুসলিম বালিকাদের জন্য একটি স্কুল স্থাপন করেন। এ স্কুলটি স্থাপিত হয় তাঁর স্বামীর মৃত্যুর প্রায় পাঁচ মাস পরে ১৯০১ সালের ১ অক্টোবর। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর সপত্নী, কন্যা ও জামাতার কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ভাগলপুরের স্বামীগৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৪. মৌলবি ও সমাজপতিদের স্কুলের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র : বাংলার মুসলমান না রীসমাজে শিক্ষাবিস্তারের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপন করেন। স্কুলটি স্থাপনের পর থেকে শান্তিপূর্ণভাবে এর কাজকর্ম তিনি পরিচালনা করতে পারেন নি। এ স্কুলের বিরুদ্ধে নানা যড়যন্ত্র চলছিল। স্কুলের ক্ষতি করার জন্য কতকগুলো লোক অহেতুক সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজপতিরাই শুধু নন, ধর্মান্ধ মোল্লা মৌলবিরাও বেগম রোকেয়ার শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রমের অঙ্গ হিসেবে বিদ্যালয় স্থাপনের প্রচেষ্টাকে ধিক্কার দিয়েছেন।
৫. অপবাদের সম্মুখীন : নারীমুক্তির উদ্দেশ্যে শিক্ষাবিস্তার করতে গিয়ে সমাজের নিন্দাগ্লানিতে বেগম রোকেয়ার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার হয়েছিল যে, “যুবতী বিধবা স্কুল স্থাপন করে নিজের রূপ যৌবনের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে।” এছাড়াও শিক্ষাবিস্তার ও সমাজহিতকর প্রতিটি কার্যকলাপে প্রতি পদক্ষেপে তাঁর প্রতি অশ্লীল গালিগালাজ, নিন্দা, বিদ্রূপ, অপমান ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা বর্ষিত হয়েছে।
৬. স্কুল উচ্ছেদের হুমকি : বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করায় সেকালে গণ্যমান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের কাছে তিনি শত্রু হয়ে উঠেছিলেন। বেগম রোকেয়ার প্রতি কেউ তুচ্ছ কারণে বিরক্ত হলেও সে ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে তারা স্কুল উচ্ছেদের হুমকি দিতেন।
৭. ধর্মীয় গোঁড়ামি : বেগম রোকেয়ার শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকটা বাধার সৃষ্টি করে। ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে ঘরের বাইরে এসে আরবি ছাড়া বাংলা, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা তৎকালীন সময়ে ছিল অসম্ভব। এ চিন্তাধারার পরিবর্তন সাধন করে মেয়েদের শিক্ষাদানে উৎসাহিত করার বিষয় দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সমাজের রক্তচক্ষু সবকিছুকে উপেক্ষা করে বেগম রোকেয়া তাঁর শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে
গিয়েছিলেন সাফল্যের দিকে।
৮. মানসিক শক্তির অভাব : সে সময়ে নারীসমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হওয়ায় বিপদসঙ্কুল সংসারে সবসময় সুরক্ষিত থাকায় নারী সাহস, ভরসা, বল একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। তাদের শোচনীয় অবস্থা চিন্তা করার শক্তিটুকুও তাদের নেই। কোন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার শক্তিও তাদের নেই। তারা মানসিকভাবে নিজেদের এতটাই পঙ্গু করে ফেলেছে। এ মানসিক শক্তির অভাব ছিল বেগম রোকেয়ার শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় বাধা।
৯. নিষ্ক্রিয়তা : নারীসমাজ কোন কাজে, কোন দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে তাদের অবসর গ্রহণের কারণে তারা যে কতটা পিছিয়ে পড়েছে সে বোধ তাদের নেই। এটা শিক্ষাবিস্তারের অনেক বড় বাধা, যার সম্মুখীন হয়েছেন বেগম রোকেয়া। এ বাধা কাটিয়ে তাদের শিক্ষার পথে নিয়ে আসতে অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে বেগম রোকেয়াকে।
১০: পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা : পুরুষশাসিত সমাজে নারী চিরকালই লাঞ্ছিত। তাদের অধিকারগুলো সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। এ গণ্ডির বাইরে নারীরা যেতে পারে না। কারণ তারা নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অসচেতন।তাই পুরুষশাসিত সমাজ বেগম রোকেয়ার শিক্ষাবিস্তারের অন্যতম বাধা। এ পুরুষশাসিত সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বেগম রোকেয়া তাঁর জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি সাহসের সাথে এগিয়ে গেছেন। কোন অপশক্তিকে তিনি পরোয়া করেন নি। বেগম রোকেয়া ছিলেন তাঁর লক্ষ্য অর্জনে সদা সচেষ্ট।
পর্যালোচনা : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বেগম রোকেয়া অসাধারণ প্রতিভাবান নারী। যিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত, বাংলার নারীমুক্তির স র্বপ্রথম পথিকৃৎ। নারীমুক্তির একমাত্র অবলম্বন শিক্ষা একথা তিনি শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই বিশ্বাস করতেন। তাঁর সমস্ত জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল অবহেলিত, লাঞ্ছিত, কূপমণ্ডূক, অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত নারীসমাজের নবজাগরণ। এ অসহায়দের ব্যথায় তাঁর অন্তর কেঁদে উঠেছিল। নারীকল্যাণ ও নারীমুক্তিই ছিল তাঁর আজীবনের কার্যকলাপ পরিচালনার মুখ্য উদ্দেশ্য। সে কারণেই অবরোধ প্রথার বিভীষিকা, পর্দার নামে অমানবিক অবরোধ প্রথা, স্ত্রীশিক্ষাবিরোধী মনোভাব এবং সর্বপ্রকার সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মসী ধারণ করে তিনি আপসহীন সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। সমাজজীবনে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অত্যন্ত শুভ। বেগম রোকেয়ার শক্তিশালী লেখনীই যে প্রচলিত
সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে অগ্রগতির পথে যাত্রারম্ভ করেছিল তা অনস্বীকার্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শিক্ষা ছাড়া যে মুসলমান জাতির চক্ষুরুন্মীলন এবং মুসলমান জাতির অর্ধেক নারীসমাজকে কূপমণ্ডূক ও অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে যে জাতীয় জাগরণ সম্ভব নয় এ সত্য কথাটি বেগম রোকেয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই বাংলার মুসলমান নারীসমাজের মধ্যে শিক্ষা কিভাবে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে সেটিই ছিল বেগম রোকেয়ার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই তিনি নারী শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে যেসব বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তার সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টাও করেছেন।নারীসমাজের মুক্তি শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তিনি শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রমে ব্রতী হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি। তাঁর শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রম অবশ্যই প্রশংসনীয়। বাংলার নারীসমাজের শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার নাম ইতিহাসের পাতায় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87/