সাক্ষাৎকারের সুবিধা ও অসুবিধা

অথবা, সাক্ষাৎকারের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর ।
অথবা, তথ্যসংগ্রহের কৌশল হিসেবে সাক্ষাৎকার পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সামাজিক গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে সাক্ষাৎকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ওকার্যকরী কৌশল হিসেবে স্বীকৃত। এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যাবলি সন্তোষজনকভাবে নির্ভরযোগ্য ও যথার্থ হিসেবে। বিবেচিত হয়ে থাকে । এ পদ্ধতির একাধিক যেমন সুবিধা রয়েছে, ঠিক অন্যদিকে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে ।
সাক্ষাৎকারের সুবিধাসমূহ : নিম্নে সাক্ষাৎকারের সুবিধাসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. উচ্চহারে উত্তরলাভ : সাক্ষাৎকার কৌশলের ক্ষেত্রে সাক্ষাগ্রহণকারী ব্যক্তিগতভাবে গবেষণার ক্ষেত্রে গিয়ে
উত্তরদাতাদের সাথে মিলিত হন এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় উপাত্ত
সংগ্রহ করেন। ফলে এ কৌশলের সাহায্যে উচ্চহারে উত্তর লাভ করা যায়। এছাড়া নিরুত্তরজনিত সমস্যা ও অনেককমানো যায়। যারা তথ্য সরবরাহ করতে অসমর্থ হন। যেমন- শিশু,
২. অশিক্ষিত, অন্ধ ব্যক্তি প্রমুখ এই শ্রেণির অন্তর্গত । কিন্তু সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদের নিকট থেকে সহজেই তথ্যসংগ্রহ করা যায় । উঁচুস্তরের লোক বিবেচনা করেন এবং তাদের কাছে প্রেরিত প্রশ্নমালার
৩.অনিচ্ছুকদের নিকট থেকে তথ্যসংগ্রহ : প্রতিটি সমাজে এমন কতিপয় ব্যক্তি রয়েছে, যারা উত্তর প্রদানে অথবা তারা মনে করেন যে, উত্তর দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই বা উত্তর সাক্ষাৎকার কৌশলের সাহায্যে এরূপ অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের নিকট করে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে সহজেই তথ্যসংগ্রহ একবারেই অনিচ্ছুক । সম্ভবত তারা নিজেদেরক জবাব দিয়ে সময় নষ্ট করতে তারা রাজি নন। সরবরাহের জন্য কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। থেকেও সাক্ষাগ্রহণকারী প্রয়োজনীয় প্রেষণা প্রদান করতে পারেন এবং গবেষণার মান উন্নত করতে পারেন। অধিকন্তু দক্ষ, নির্ভরযোগ্য
৪. সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব : সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় সাক্ষাগ্রহণকারী এবং উত্তরদাতা উভয়েই সামনাসামনি উপস্থিত হয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহ করতে পারেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং শিক্ষিত সাক্ষাগ্রহণকারী সমস্যাবলির অপেক্ষাকৃত গভীরে প্রবেশ করে সঠিক ও তথ্যসংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
৫. আড় পরীক্ষার সম্ভাবনা : একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাক্ষাগ্রহণকারী কেবল উত্তরদাতার সাথে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট হন না বরং উত্তরদাতা পরিবেশিত তথ্য সঠিক কি না তা জানার জন্য আড় প্রশ্নের সহায়তা গ্রহণ করেন । আর এটি কেবল সাক্ষাৎকার কৌশলের মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
৬. নমনীয়তা : উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার কৌশলের অধিক নমনীয়তা লক্ষ করা যায়। এখানে উত্তরদাতা।কোন প্রশ্ন বুঝতে অসমর্থ হলে তার বুঝার সুবিধার জন্য সাক্ষাগ্রহণকারী প্রশ্নটি ঘুরিয়ে বা নতুন শব্দ বিন্যাসের মাধ্যমে পুনরায় প্রশ্ন করে উত্তরদাতার নিকট থেকে সঠিক উত্তরটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন। পর্যবেক্ষণ কিংবা ডাক প্রশ্নমালার ক্ষেত্রে এ ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় না ।
৭. আবেগ, অনুভূতি ও ভয় উপলব্ধি করা সম্ভব : সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহের জন্য উত্তরদাতার সাথে আলোচনাকালে কখনো কখনো উত্তরদাতা আবেগপূর্ণ এবং উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আবার নিজের মনের ভয়ের অনুভূতির জন্য অনেক সময় উত্তর দিতে ইতস্তত (Hesitant) করেন। এমনকি কখনো কখনো ঘটনা বা অবস্থা অতিরঞ্জিত (Exaggerate) করে বা অবমূল্যায়ন (Underestimate) করে বর্ণনা করেন। সাক্ষাৎকারের কৌশলের মাধ্যমে উত্তরদাতার এরূপ মানসিক অবস্থা ভালো করে উপলব্ধি করে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয ়।
সাক্ষাৎকারের অসুবিধাসমূহ : সামাজিক গবেষণায় প্রাথমিক তথ্যসংগ্রহের বহুল ব্যবহৃত ও কার্যকরী কৌশল হিসেবে
সাক্ষাৎকারের কতিপয় সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এর কতিপয় বাস্তব অসুবিধাও রয়েছে। নিম্নে অসুবিধাগুলো আলোচনা করা হলো :
১. ব্যয়বহুল কৌশল : সাক্ষাৎকার একটি ব্যয়বহুল তথ্যসংগ্রহ কৌশল । কারণ এর জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ, বেতনভাতা, ভ্রমণভাতা, নমুনা নির্বাচন, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, গণযোগাযোগ প্রভৃতির জন্য প্রচুর অর্থের দরকার হয় বলে এটি একটি ব্যয়বহুল কৌশল হিসেবে খ্যাত ।
২. পক্ষপাতদুষ্টতা : সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মুখোমুখি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী তার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, নৈতিকতা ইত্যাদি দ্বারা উত্তরদাতাকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। এ ফলশ্রুতিতে তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টতা দেখা দেয়।
৩. আত্মগোপনের সুযোগের অভাব : ডাক প্রশ্নমালার ক্ষেত্রে উত্তরদাতার আত্মগোপনের সুযোগ থাকলেও সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে উত্তরদাতার আত্মগোপনের সুযোগ থাকে না। কারণ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী উত্তরদাতার পূর্ণ পরিচয় জানেন । এর ফলে উত্তরদাতা অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তর দিতে চান না। বিশেষকরে তার নিকট থেকে সংবেদনশীল অনেক প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে বের করে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে ।
৪. সাক্ষাৎদাতাকে রাজি করানো কষ্টকর : সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় অনিচ্ছুক উত্তরদাতাকে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করে এবং প্রেষণা দেয়া সত্ত্বেও উত্তরদানে রাজি করানো খুবই কষ্টকর । এমতাবস্থায় উত্তরদাতা সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় পূর্ণ মনোনিবেশ করেন না। ফলে এরূপ ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
৫. স্মৃতির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা : সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে উত্তরদাতাকে চিন্তাভাবনা এবং অন্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা না করে এবং নথিপত্র না দেখে উত্তর দিতে হয় বলে স্মৃতির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হতে হয় । এ অবস্থায় উত্তরদাতা প্রদত্ত তথ্যের সঠিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় ।
৬. অতি উদ্দীপনাজনিত সমস্যা : সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য লাভের জন্য উত্তরদাতাকে প্রেষণা বা উদ্দীপনা দেয়া হয় । কিন্তু অনেক সময় অত্যধিক প্রেষণার কারণে উত্তরদাতা মানসিক স্থিরতা হারিয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে বেশি কথা বলতে গিয়ে প্রকৃত বক্তব্য থেকে দূরে সরে যান। এর ফলে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না ।
৭. উত্তরদাতার সহজলভ্যতার অভাব : সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় প্রায় সময়ই নমুনাভুক্ত অনেক উত্তরদাতাকে বিভিন্ন কারণে যেমন- বাসস্থান পরিবর্তন, মৃত্যু, কর্মব্যস্ততা, বিদেশ গমন প্রভৃতি কারণে যথাসময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশেষকরে গবেষণা এলাকা যদি ব্যাপক বিস্তৃত হয় তাহলে এ সমস্যা আরো প্রকট হয় । অধিকন্তু সামাজিক গতিশীলতার সমাজে উত্তরদাতাকে ঘরে পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার । ফলে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করা খুবই অসুবিধাজনক ।
৮. সময় সাপেক্ষ : সামাজিক গবেষণায় প্রাথমিক তথ্যসংগ্রহের অন্যান্য কৌশলের তুলনায় সাক্ষাৎকার সময় সাপেক্ষ কৌশল । কারণ প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মতৎপরতা এবং মাঠপর্যায়ে উত্তরদাতাদের খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সাক্ষাৎকার পদ্ধতিটি একটি প্রাচীনতম পদ্ধতি হলেও আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্বের অধিকাংশ সমাজ গবেষণার প্রাসঙ্গিক তথ্য সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। এ পদ্ধতি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে শেখায়, তবে তা সত্ত্বেও এ পদ্ধতিতে তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হতে হয় ।