অথবা, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব কী? এর কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, কী কী কারণে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়? আলোচনা কর।
অথবা, এক সংস্কৃতিতে অন্য সংস্কৃতির কোন আঘাত আসে কি? বর্ণনা দাও
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রত্যেক সমাজের জীবনধারার স্বতন্ত্ররূপ অর্থাৎ স্বতন্ত্র জীবনযাপন প্রণালীকে সংস্কৃতি Culture বলা যায়। সংস্কৃতি মাত্রই পরিবর্তনশীল। বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে পৃথিবীর প্রতিটি জাতি একে অপরের অত্যন্ত কাছাকাছি। এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ঘটা স্বাভাবিক। আবার সমাজে বিভিন্ন মানুষের চিন্তায়, কাজে, আদর্শে, আচরণে, মূল্যবোধে ও মূল্যায়নে পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাই এ পার্থক্য কখনো ব্যক্তিস্বার্থ, কখনো দল,
কখনো বা ধর্মীয় কারণে হয়ে থাকে। এসব পার্থক্যের কারণে সমাজ যখন একজন অন্যজনের উপর প্রাধান্য লাভের চেষ্টা করে তখনই দেখা দেয় এ সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব।
সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের কারণসমূহ : একটি সমাজে বিভিন্ন কারণে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। নিম্নে কতকগুলো কারণ উল্লেখ করা হলো :
১. সামাজিক পরিবর্তন : বর্তমান বিশ্বে মানুষের আচারব্যবহার, পদমর্যাদা, অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ প্রভৃতিতে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। সে সাথে মানুষের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তনের গতিধারায় আমাদের বাংলাদেশেরও সামাজিক পরিবর্তন এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তন সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে বলে এ পরিবর্তন কখনো দ্রুত আবার কখনো মন্থর। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বস্তুগত সংস্কৃতি দ্রুতগতিতে পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু অবস্তুগত সংস্কৃতি (ভাষা, সাহিত্য) মন্থরগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে দেখা দিচ্ছে Cultural conflict বা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। এমনিভাবে এক সমাজের Culture যখন অন্য সমাজের সংস্পর্শে আসে তখন তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ।
২. সাংস্কৃতিক শূন্যতা : দুটি পারস্পরিক সংস্কৃতির কোন একটির বা উভয়ের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক শূন্যতা। আধুনিক যান্ত্রিক ও নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের ভোগবিলাসে ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের এককথায় মানুষের বস্তুগত ও অবস্তুগত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে এ পরিবর্তিত সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্ট হয়। এছাড়াও শিল্পায়নের ফলে গ্রাম থেক । লোকজন শহরের দিকে ধাবিত হয়। গ্রাম ও শহরের সংস্কৃতির সার্থক সামঞ্জস্য গড়ে না উঠায় Cultural conflict দেখা দেয়।
৩. সামাজিক অসংগতি : কোন সমাজের ধরন, রীতিনীতি ইত্যাদির প্রসার লাভ করে অন্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যখন পুরানো কার্যপ্রণালী, বিশ্বাস, দীর্ঘকালের প্রতিষ্ঠিত আচার আচরণ নতুনত্বের দ্বারা ভেঙে যায় তখন পুরানোর সাথে নতুনের সংঘাত হয় । অর্থাৎ কোন আরোপিত সংস্কৃতি যখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তখন সমাজে Cultural conflict দেখা দেয় ।
৪. সাংস্কৃতিক পার্থক্য : একই সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির লোক বাস করে। যেমন- মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি। তাদের পারস্পরিক আচার আচরণে পার্থক্য রয়েছে, ফলে তাদের বিরাজমান সাংস্কৃতিক বৈষম্যের জন্ Cultural conflict দেখা দেয়। অপরদিকে, সবাই স্বীয় ধর্মের আদর্শ ও গুণকীর্তনে আগ্রহী। সমাজে যখন এরূপ ধর্মীয় চেতনা জাগে তখন এক ধর্মাবলম্বীর সাথে অন্য ধর্মাবলম্বীর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
৫. আদর্শগত পার্থক্য : আদর্শগত বিরোধ সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ। ধর্ম, পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন। এ ভিন্নধর্মী মতাদর্শ বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।
৬. পৃথকীকরণ : সমাজে এমন কিছু ব্যক্তি থাকে যারা অন্যান্যদের
সাথে মিশে চলতে পারে না। সমাজজীবনে এমন ব্যক্তির পারস্পরিক ক্রিয়ায় অসামঞ্জস্যতার জন্য সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় ।
৭. সাংস্কৃতিক সংস্কার : যখন কোন ব্যক্তি পুরোপুরি স্বদেশ বা বিদেশের সংস্কৃতির কোনটাকে না মেনে দুটির মাঝামাঝি চলে তখন এ ধরনের সংস্কারের জন্য সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
৮. সামাজিক শ্রেণীকরণ : সমাজের উঁচু শ্রেণী যখন নীচু শ্রেণীকে শোষণ করে তখন পরস্পরের বিভিন্নতা থেকেও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
৯. বর্ণ বৈষম্য : মানুষে মানুষে নির্ণীত বর্ণ বৈষম্যের কারণে তাদের মনোভাব ও আচরণে ভিন্নতা থাকে এবং Cultural conflict দেখা দেয়। যেমন- শ্বেতকায় জাতি নিজেদেরকে কৃষ্ণকায় জাতি অপেক্ষা উচ্চস্তরের মনে করে। এ ধরনের মনোভাব থেকেও Cultural conflict দেখা দেয়।
১০. উপেক্ষা করা : বিভিন্ন সংস্কৃতির লোক একে অপরকে Tolerate করতে পারে না। ফলে Cultural conflict দেখা দেয় ।
যেমন— আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপজাতীয়রা আমাদের মতো সাধারণ লোকদেরকে সহ্য করতে পারে না, ফলে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় । উপর্যুক্ত আরোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানিক আলোচনার সংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব একটি কেন্দ্রীয় প্রত্যয়।
উপসংহার : MacIver বলেছেন, “Our culture is what we are, our civilization is what we use.” কাজেই সংস্কৃতি একটি জাতির ঐতিহ্য, প্রাণ, আবার সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে অসংগতি সৃষ্টি করে সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অসম সংস্কৃতি পরিবর্তন, পরস্পর বিরোধী সংস্কৃতির উপস্থিতি, সংস্কৃতির দ্বন্দ্বে প্রভৃতি কারণে অসম সামাজিক পরিবর্তন ঘটতে পারে যা শান্তিপ্রিয় মানুষের কাম্য নয়।