সাংবাদিক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? আলোচনা কর।

অথবা, সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিকল্পে যেসকল পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী সেগুলো আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা :
বাংলাদেশে একবিংশ শতাব্দীর সূচনা হয়েছে গণমাধ্যমের বিপুল বিস্তার দিয়ে। এখন ঢাকা ও অন্যান্য শহর মিলিয়ে মোট ৭৬৬টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে শুধু দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাই ৪০৭টি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড মিলিয়ে মোট টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ১৪টি এবং আরও দু’টি অনুমতি লাভের পর্যায়ে রয়েছে। রেডিও নেটওয়ার্ক হিসেবে সচল বাংলাদেশ বেতার এবং রেডিও টুডে, রেডিও আমার, এবিসি রেডিও ও রেডিও ফুর্তি। গণমাধ্যমে সংবাদ সরবরাহের জন্য কাজ করছে ৭টি বাংলাদেশী সংবাদ সংস্থা। এই যে এত সংবাদ মাধ্যম এগুলোতে কাজ করছে প্রচুর সংখ্যক সাংবাদিক। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মোট সাংবাদিকের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা মাত্র ৬ ভাগ। মনে করা হয় সাংবাদিকতা হচ্ছে পুরুষের পেশা, এরা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনুপযুক্ত। নারীদের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকেই সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনুপযুক্ত মনে করা হয়। আমাদের এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যই তাকে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে।

সাংবাদিক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে : সাংবাদিক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কতিপয় সুপারিশ নিয়ে দেওয়া হলো ।
১. নারীর নিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কোটা সুবিধা এবং অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সাংবাদিক হিসেবে গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে না। নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে করেছে সেখানে ‘নারী ও গণমাধ্যম’ সম্পর্কে যে নীতিগুলো রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। নারীকে সংবাদ মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার পথে, তার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রমোশন পাওয়ার পথে, তার জন্য সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ তৈরির পথে যে বাধাগুলো রয়েছে সেগুলো শনাক্ত করতে হবে এবং সেসব বাধা অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. কর্মরত নারী সাংবাদিকের অধিকার রক্ষায় নীতিমালা ও আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে। এসব নীতি ও বিধির প্রয়োগ নিশ্চিত হয় এমন পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. নারী সাংবাদিকেরা খোলাখুলিভাবে তাদের প্রয়োজন ও সমস্যার কথা বলতে পারে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
৭.কর্মরত নারী সাংবাদিকের দক্ষতা ও যোগ্যতাকে জেন্ডার সংবেদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে এবং তাদের ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে।
৮.নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ পাওয়ার সমান সুযোগ দিতে হবে।
৯.সমানাধিকারের ভিত্তিতে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
সাম্প্রতিক ওয়েজ বোর্ড অনুসরণে যথাযথ বেতন দিতে হবে।
১০. কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, লিঙ্গ বৈষম্যমূলক মন্তব্য বা আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
১১. সাংবাদিকতায় নারীর অবস্থান খতিয়ে দেখার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
১২. পরিবারবান্ধব কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশু পরিচর্যাগার, যাতায়াত ও শৌচাগারের সুব্যবস্থাকে শুধু নারীর প্রয়োজন নয়, সকল সাংবাদিকের মানবাধিকার বলে শনাক্ত করতে হবে।
১৩. সর্বোপরি, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ দূর করতে হবে। সাংবাদিকতাকে যেন পুরুষের পেশা মনে না করা হয় সবার মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সকলকে জেন্ডার সংবেদনশীল মানসিকতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে সাংবাদিকতাকে ‘পুরুষের পেশা’ বলে মনে করা হয়। নারী হওয়ার কারণে বা লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সাংবাদিকতা পেশাকে নারীর জন্য অনুপযুক্ত মনে করা হয়। তথ্য দেওয়ার ও পাওয়ার অধিকার যেখানে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার বলে স্বীকৃত, সেখানে তথ্যদানের এ পেশায় নারীর সীমিত উপস্থিতি শুধু আলোচনাযোগ্য বিষয়ই নয়, একটি আশংকাজনক বিষয়ও বটে। সাংবাদিকতায় নারী যদি পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণ না করে, তার অর্থ হল সমাজের অর্ধেকের কণ্ঠস্বর আমরা শুনছি না। অনেকের মতামত চাপা পড়ে রয়েছে। গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ না বাড়লে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অর্জন কখনও সম্পূর্ণ হবে না। যদি মাধ্যম জগতে সাংবাদিকতায় উৎসাহী নারীর জন্য যথেষ্ট রোলমডেল তৈরি না হয়, তবে তারা এ জগতে প্রবেশ করতে ও টিকে থাকতে অনুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটির বিদ্যমান সমস্যাগুলোর যেমন যথাযথ বিশ্লেষণ প্রয়োজন, তেমনিই প্রয়োজন সমস্যাগুলো দূর করার জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ। এ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো দূর হবে এবং নারীর পূর্ণমাত্রায় সাংবাদিকতায় অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়।