অথবা, সাঁওতাল উপজাতির জীবনপ্রক্রিয়ার বিবরণ দাও।
অথবা, সাঁওতাল উপজাতিদের জীবন ধারা লেখ।
অথবা, সাঁওতাল উপজাতিদের আর্থসামাজিক জীবন সম্পর্কে লিখ।
উত্তরঃ ভূমিকা : বর্তমানে আধুনিক সভ্য সমাজে যারা বন ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে আসছে তাদেরকে বুঝাতে আদিম, আদিবাসী, উপজাতি প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। বর্তমানের সভ্য সমাজের সাথে এদের সম্পূর্ণ যোগসাজশ না থাকলেও সভ্যতার ছোঁয়া যে একেবারে পায়নি একথা বলা যায় না। কিছু কিছু উপজাতি আধুনিক শিক্ষাগ্রহণ করছে, সভ্যতার সংস্পর্শে আসছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ উপজাতি পাহাড় এবং বনাঞ্চলে বসবাস করে। উপজাতিদের জীবনচরিত্র কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
সাঁওতাল উপজাতির জীবনধারা : বাংলাদেশে সাঁওতাল উপজাতির বাস দীর্ঘদিন ধরে। সাঁওতাল উপজাতির জীবনধারা তুলে ধরা হলো :
১. নামকরণ : সাঁওতালদের নামকরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের সাঁওতাল পরগণায় বসবাসকারীরা সাঁওতাল নামে পরিচয় লাভ করে।
২. সাঁওতালদের অবস্থান : সাঁওতালরা বাংলাদেশের প্রাচীনতম অধিবাসী। তারা বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, রগুড়া, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বাস করে। এছাড়াও সিলেট, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার জেলায় তারা বসবাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী এ দেশে দু’লাখের মত সাঁওতাল বাস করে ।
৩. দৈহিক আকৃতি : সাঁওতালদের আকৃতি মাঝারি গড়নের। এদের গায়ের রং কালো, ঠোঁট ও নাক মোটা, মুখগহ্বর বড়। এদের চোখ ছোট এবং মাথার খুলি গোল। তারা খুব পরিশ্রমী। পুরুষ সাঁওতালের মুখে দাড়ি গোঁফ কম থাকে। তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। দৈহিক গড়নে তারা প্রাক দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর ন্যায়।
৪. সাঁওতালদের দেবতা : আদিবাসী সাঁওতালরা ছিল জড় উপাসক। তারা বিভিন্ন দেবদেবীতে বিশ্বাস করত। এরা দেবতাকে বলে ‘বোঙ্গা’ । ঠাকুর জিয়ো তাদের সৃষ্টিকর্তা। তাই অন্যান্য দেবতাদের তুলনায় ঠাকুর জিয়ো অনেক বেশি সম্মানের। তারা অনেক অপদেবতায়ও বিশ্বাস করত। তাদের দেবতাদের মধ্যে দা বোঙ্গা, বীর বোঙ্গা, সিং বোঙ্গা, ডাড্ডি বোঙ্গা, মারাংবুরুর নাম উল্লেখযোগ্য। তারা সূর্যকে পুরুষ এবং চন্দ্রকে নারী হিসেবে চিহ্নিত করে। মারাংবুরু তাদের জাতিগত দেবতা।
৫. ধর্মীয় অনুষ্ঠান : সাঁওতালরা ধর্মপ্রাণ হলেও তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জাঁকজমক কম। তাদের নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ নেই, পূজামণ্ডপ’ নেই আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নির্দিষ্ট কোনো নিয়মরীতি নেই। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। তারা যেসব দেবদেবীর পূজা করে, তাদের বাস্তব অস্তিত্ব নেই; তারা সবাই কল্পিত। বাড়ির উঠানে উঁচু ঢিবি তৈরি করে সেখানে পূজা অনুষ্ঠান পালন করে। নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করলে সেখানেই তারা পূজার জন্য জায়গা তৈরি করে।
৬. সংস্কারে বিশ্বাস : সাঁওতালরা কতকগুলো সংস্কারে বিশ্বাস করে। তারা বিভিন্ন ধরনের নাচগান ও পান ভোজের আয়োজন করে। তাদের পূজা পার্বণে নাচগান অপরিহার্য অংশ। তারা প্রতি মাসে বিভিন্ন উৎসব পালন করে, যেমন- বৈশাখ মাসে হোম, জ্যৈষ্ঠ মাসে এরাবা সাদরি, আষাঢ় মাসে হাড়িয়াও এবং এরকঃসিম, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিনে দিবি, কার্তিক মাসে নওয়াই, অগ্রহায়ণ মাসে সংক্রান্তি, পৌষ মাসে সোহরাই, মাঘ মাসে মাঘ সিম পূজা, ফাল্গুন মাসে সালসেই ও বসন্ত উৎসব, চৈত্র মাসে বোঙ্গাবুঙ্গি উৎসব পালন করে।
৭. সামাজিক উৎসব : সাঁওতালরা বিভিন্ন পূজা অর্চনা, নৃত্য গীতি, পান ভোজন, আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে সামাজিক উৎসব পালন করে। পৌষ মাসের সোহরাই উৎসব আদিবাসী সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় উৎসব।
৮. বাড়িঘর : সাঁওতালরা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তারা তাদের বাড়িঘর সর্ব
দা পরিচ্ছন্ন রাখে। গৃহ নির্মাণে বাঁশ, ছন, খড় প্রভৃতি ব্যবহার করে। সচরাচর তাদের ঘরে কোনো জানালা থাকে না।
৯. সাংস্কৃতিক জীবন : সাঁওতালরা আখড়ায় বসে সংস্কৃতি চর্চা করে। নিজেদের সংস্কৃতির যাবতীয় বিষয়ে তারা এখানে জ্ঞান লাভ করে। আখড়ায় সব বয়সীদের যাতায়াত আছে। মূলত তারা ধর্মীয় কার্যের অংশ হিসেবে নাচগানের আয়োজন করে। আখড়ায় তারা ধর্মীয়, নৃত্যগীত প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সাঁওতালদের ‘ঝুমুর নাচ’ তাদের
সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। ঝুমুর নাচের মাধ্যমে তারা আনন্দ উল্লাস করে। বিবাহ অনুষ্ঠানে তারা ‘দোন’ ও ‘ঝিকা’ নাচের আয়োজন করে। বৃষ্টিকে প্রার্থনা করে ‘লাগরেঙ’ নাচের মহড়া দেয়। বসন্ত উৎসব ও সোহরাই উৎসবে জাতুর নাচের মহড়া দেয়।
১০. খাদ্যদ্রব্য : সাঁওতালরা প্রধানত সমভূমিতে বাস করে। তাদের প্রধান খাদ্য ভাত। এদের খাদ্য তালিকায় রুটি, মাছ, মাংস, শাকসবজি প্রভৃতি আছে। তারা শূকর, গরু, খরগোশ, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, কাঁকড়া, বনবিড়াল, মনুহার, বেজি, ইঁদুর, কুচিয়া, গোসাপ প্রভৃতির মাংস ভক্ষণ করে। তারা নিজেদের প্রস্তুতকৃত মদও পান করে।
১১. পোশাক পরিচ্ছদ : সাঁওতালরা খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদে এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। তাদের পোশাক পরিচ্ছদে কোনো জাঁকজমক নেই। তারা তাঁতে বোনা পানচি ও পাড়হাট নামের শাড়ি পরে। পুরুষরা ধুতি ও নেংটি পরে। তাদের এলাকার বাইরে গেলে মহিলারা শাড়ি, ব্লাউজ পরে এবং পুরুষরা লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্ট পরে।
১২. ভাষা সাহিত্য : সাঁওতালদের ভাষা অস্ট্রো এশিয়াটিক পরিবারভুক্ত। তাদের ভাষায় বাংলার প্রভাব অনেক বেশি। রাজশাহী বর্ষাপাড়া গ্রামে ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ সাঁওতালদের ভাষায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। তাদের রূপকথা, লোককথা, লোকগীতি, লোকসংস্কৃতির লিখিত কোনো গ্রন্থ নেই। এগুলো মুখে মুখে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। তারা বাংলাভাষার প্রতি বেশ আগ্রহী। অধিকাংশ সাঁওতাল বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে।
১৩. বিবাহ : সাঁওতালরা বিবাহকে নিজেদের ভাষায় বাগলা বলে। তাদের সমাজে বহির্গোত্র বিবাহ প্রচলিত । বিবাহ অনুষ্ঠানে তারা নাচ, গান, পান ভোজন, আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে।
১৪. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : এক সময় সাঁওতালরা ফলমূল সংগ্রহ ও শিকারের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করত। বর্তমানে তারা কৃষির উপর নির্ভরশীল। চাষকাজে তারা ছোট ছোট লাঙল ব্যবহার করে। নারী পুরুষ সবাই কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করে। তারা কুলি, জেলে, চা বাগানের কাজও করে।
১৫. তালাক প্রথা : সাঁওতালরা কদাচিৎ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায়। তালাক প্রদানের মাধ্যমে তারা এ কাজটি করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ লেগে থাকলে তারা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে স্বামীকে অর্থদণ্ড ও পনের টাকা পরিশোধ করতে হয়। তারা বিধবাবিবাহকে সমর্থন করলেও বহুবিবাহে সমর্থন দেয় না।
১৬. মৃতের সৎকার : সাঁওতালরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ্য করে। দাহ্য করার রীতি গোত্রও স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে নিয়ে যায়। মৃতের জ্যেষ্ঠ পুত্র বা অনুপস্থিতিতে আত্মীয়স্বজনের কেউ চিতায় আগুন দেয়। তারা মৃত্যুর পরবর্তী স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করে। এজন্য তারা পুণ্য কাজের প্রতি আগ্রহী।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সাওতাল উপজাতিরা বহু বছর ধরে নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এ দেশে বসবাস করে আসছে। প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে থেকে তারা জীবন অতিবাহিত করেছে। কোনো কোনো উপজাতীয় সমাজ তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।