চাকমা উপজাতিদের জীবনধারণ প্রণালি সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মধ্যে চাকমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রণালির বর্ণনা দাও।
অথবা, চাকমা আদিবাসীদের পরিচয় দাও। চাকমা উপজাতিদের জীবনধারণ প্রণালির বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের একমাত্র পার্বত্য অঞ্চল হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম। উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নিম্ন পর্বত শ্রেণি হতে দক্ষিণে বার্মার আকিয়াব জেলা ও পূর্বে ভারতের লুসাই পাহাড় ও বার্মার আরাকান পর্বতমালা থেকে পশ্চিমে চট্টগ্রামের উপকূলীয় সমভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত এ পার্বত্য অঞ্চলের আয়তন হচ্ছে ৫,১৩৮ বর্গমাইল। এ উপ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে ডজন খানেক উপজাতি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করে। এ উপজাতিরা হলো বাংলাদেশের পুরানো ঐতিহ্যের ধারক। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতি আধুনিকতার সংস্পর্শে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও উপজাতিদের মধ্যে এ ধরনের লক্ষণ দেখা যায় না। তারা নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষায় ছিল যথেষ্ট তৎপর। এ উপজাতিদের মধ্যে প্রধান হলো চাকমা, মগ, ত্রিপুরা, তনচাঙ্গিয়া, বানজুগি, পাংখো, মুরং, লুসাই, চাক, খুমি প্রভৃতি। তবে এদের মধ্যে চাকমারা ছিলেন,
সংখ্যাগরিষ্ঠ। চাকমা উপজাতির দৈনন্দিন জীবন প্রণালি : নিম্নে চাকমা উপজাতিদের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালি বর্ণনা করা হলো :
১. চাকমাদের পরিচিতি : চাকমারা ভারতীয় আর্য দলের বংশধর। এরা ছিলেন অত্যন্ত উন্নত এবং সংখ্যায় সর্বাপেক্ষা বেশি। এরা সমগ্র উপজাতি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি এবং অসংখ্য গোষ্ঠী বা গোজায় বিভক্ত। গোড়ার দিকে এদের মধ্যে চারটি সম্প্রদায় ছিল, যথা ধুইয়া, কুর্য, ধাবানা ও পিরাভাঙ্গা।
২. চাকমাদের জীবিকার্জন : চাকমাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায় হলো জুম চাষ। এ চাষ প্রণালি ছিল গতানুগতিক চাষাবাদ প্রণালি থেকে একটু আলাদা বৈশিষ্ট্যের।
৩. বাসগৃহ নির্মাণ : চাকমাদের বাসগৃহ নির্মাণ কৌশল ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্যের। তারা মাটি থেকে ছয় ফুট উঁচু মাচানের উপর ঘর নির্মাণ করতেন এবং তাদের নির্মিত ঘরগুলো দেখতে ছিল বেশ সুন্দর। বাড়িগুলো ছিল বেশ সাজানো। ঘরগুলো সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে তৈরি ছিল।
৪. সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস : চাকমারা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। তাদের পরিবারকাঠামো ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পারিবারিক প্রধান গোত্রের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। প্রতিটি গোত্র আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত ছিল। গোত্র প্রীতি ছিল তাদের মধ্যে প্রবল। গোত্র এবং উপজাতির প্রত্যেকে একে অপরের সাথে ভ্রাতৃ সদস্যের মতই পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ
ছিল । চাকমা সমাজ প্রায় দেড় শতাধিক গোত্র নিয়ে গঠিত ছিল। যে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় এসব গোত্র একে অপরের সাথে সম্পর্কিত ছিল এবং সাহায্যার্থে এগিয়ে আসত। তবে বর্তমানে চাকমা সমাজব্যবস্থা আধুনিক সমাজব্যবস্থার দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে।
৫. বিবাহরীতি : চাকমাদের মধ্যে সাধারণত তিন প্রকার বিবাহ হয়ে থাকে। যেমন- প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করা, পরস্পর পছন্দ করে বিবাহ এবং বন্দোবস্ত বা নিষ্পত্তিমূলক বিবাহ করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কনেে রর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিবাহ দেওয়া হতো।
৬. আচার অনুষ্ঠান : চাকমা সমাজে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। কোনো চাকমা মহিলা পাঁচ থেকে সাত মাসের সন্তান সম্ভবা হলে ‘জংমাল’ নামে এক পূজা দেওয়া হতো। গর্ভবতী মহিলার ইচ্ছামত বিভিন্ন জিনিস খাওয়ানো হতো। চাকমা সর্দারের চট্টগ্রাম জমিদারির অধীন ‘বানানগর রাঙ্গুনিয়ায়’ ও মং সর্দারের চট্টগ্রাম জমিদারির অধীন ‘পাহাড়তলী রাজন’ বাংলা বৎসরের শেষে ‘মহামুণির মেলা’ বসত। তাদের মধ্যে অপর প্রচলিত উৎসব ছিল ‘পানাহা বা পুনাহা’ । তখন তারা শীতের ফসল তোলার পর আনন্দোৎসব ও পান ভোজনোৎসবে মিলিত হয়। ভাল ফস ল, সম্প্রদায়ের সার্বজনীন উন্নতি, অসুখ, মহামারি ও অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা পূজার্চনা করত।
৭. উত্তরাধিকার নির্ধারণ প্রক্রিয়া : চাকমা সমাজব্যবস্থায় পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পুত্ররা পায়। তাদের সামাজিক বিধান অনুসারে বিধবা মা ও অবিবাহিত বোনদের ভরণপোষণ করতে হয়। উত্তরাধিকার নির্ণয় করার ক্ষেত্রে পুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্রের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল । চাকমা সর্দার পরিবারে আদি পুরুষ থেকে জ্যেষ্ঠ পুত্রের উত্তরাধিকার লাভের বিধান ছিল।
৮. পোশাক-পরিচ্ছদ : চাকমা সমাজে পুরুষেরা ধুতি ও ঘরে বোনা কোট এবং মাঝে মাঝে পাগড়া পরত। স্ত্রীলোকেরা ‘পিনধান’, ‘খাদি’ ও মাঝে মাঝে ‘খাবাং’ ব্যবহার করে এবং কখনো কখনো শাড়ি ব্লাউজও পরত ।
৯. খেলাধুলা : চাকমাদের মধ্যে হা-ডু-ডু খেলা, ফার খেলা, লাটিম খেলা, কুস্তি, রশিটানা, সাঁতার ও দৌড় প্রতিযোগিতা প্রচলিত ছিল। ছেলেদের প্রিয় খেলা ছিল পাটি খেলা, গিলা খেলা প্রভৃতি। এছাড়া তারা আষাঢ়ী পূর্ণিমা,
আশ্বিনী পূর্ণিমা ও চৈত্র সংক্রান্তি পালন করত। এছাড়া তারা প্রতিটি পূর্ণিমা, অমাবশ্যা, অষ্টমী এবং চতুর্দশী তিথিকে পুণ্য তিথি হিসেবে পালন করত। সকল ধর্মীয় তিথিতে তারা নিকটবর্তী বিহারে গিয়ে বৌদ্ধ মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য দান ও প্রদীপ জ্বালিয়ে দিত।
১০. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : চাকমাদের মধ্যে মৃত্যুর পর পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মৃত দেহ পুড়িয়ে ফেলা হতো এবং পাঁচ বৎসরের ছোট শিশুকে কবর দেওয়া হতো। মৃত দেহ পোড়ানোর জন্য প্রতিটি এলাকায় আলাদা ধরনের শ্মশান ছিল। তবে ভিক্ষু ও ধনী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃতদের স্মরণে সৌধ নির্মাণ করা হতো।
১১. কুসংস্কার : অনেকের মতে চাকমা সমাজে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। কারণ, তাদের মধ্যে দৈত্য দানবে বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। রোগ মুক্তির জন্য তারা ঝাড়ফুকে বিশ্বাস করত, যা আধুনিক সমাজব্যবস্থার সাথে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ধরনের কুসংস্কার কিছুটা দূরীভূত হতে চলেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপজাতিদের মধ্যে চাকমারা যথেষ্ট উন্নত ও আধুনিক মনোভাবাপন্ন। বর্তমানকালের অবস্থা বিবেচনায় এ বিবরণের মধ্যে কিছুটা গরমিল লক্ষ করা গেলেও তা ছিল সমাজ পর্যালোচনার ফসল। বর্তমান তবে অন্যান্য উপজাতিদের অবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার দিক থেকে চাকমারা ছিলেন উন্নত। কারণ, অবস্থার একটু পিছন দিকে তাকালে উপজাতিদের বিবরণ একবারে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের চাকমাদের সামাজিক কাঠামো ও পরিবার কাঠামো ছিল যথেষ্ট আধুনিক মানসম্মত। তবে সময়ের পরিবর্তনে এটা আরো পরিবর্তিত হবে বলে মনে করছি।