অথবা, সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিবার কার্যাবলিতে যে পরিবর্তনের ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা
বর্ণনা কর।
অথবা, সাম্প্রতিক পরিবারের কার্যাবলির পরিবর্তিত রূপ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক, আদিম এবং ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান। পরিবার সমাজকাঠামোর মৌল অঙ্গ সংগঠন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবার বলতে বুঝায় এমন একটি ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন, যেখানে বৈবাহিক ও রক্তসম্পর্ক সূত্রে স্বামী-স্ত্রী তাদের অবিবাহিত সন্তানসহ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তানাদির স্ত্রী-পরিজনসহ বসবাস করে। বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবার কাঠামো ও কার্যাবলিতে অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতি এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে আধুনিক অনেক সমাজের মতো আমাদের সমাজেও পরিবর্তন এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পরিবারের গঠন (structure) ও কার্যাবলিতে (Functions) এসেছে পরিবর্তন। পরিবারের অনেক দায়িত্ব বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে পরিবারের কার্যাবলিতে পরিবর্তন (Functional change of family in Bangladesh) :
কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশে পরিবারের কার্যাবলিতেও সম্প্রতি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিম্নে তা আলোচিত হলো :
পরিবারের প্রধান দু’টি কাজ হলো স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও সন্তান জন্মদান। পরিবারের এ দু’টি কাজের মধ্যে প্রথমটিতে আমাদের সমাজে তেমন পরিবর্তন আসেনি। তবে রাষ্ট্রের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ও বর্তমানে আর্থিক নিরাপত্তার জন্য কম সন্তান জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও ঘরের বাইরে কাজ করছে। এ কারণে শিশুদের দিবাযত্ন কেন্দ্র বা নার্সারীতে রাখার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই গবেষণার ফলে দেখা গেছে যে, নার্সারিতে রাখা শিশুদের সুষ্ঠু ব্যক্তিত্বের বিকাশ হচ্ছে না। তাদের কেউ বা হীনম্মন্যতায় ভোগে, কেউবা কিশোর অপরাধী হয়ে গড়ে উঠছে। ফলে সমাজে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পূর্বে যেখানে ছোট ছোট শিশুদের শিক্ষার ভিত্তি পরিবার গড়ে উঠত বর্তমানে তা বিভিন্ন নার্সারি স্কুল ও ডে কেয়ার সেন্টারগুলোতে হচ্ছে।
- বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পরিবারগুলো অদ্যাবধি উৎপাদন (Production), আয় (Income) ও ভোগের (Consumption) একক। তবে আধুনিক শহুরে পরিবারগুলো উৎপাদনের একক নয়, তারা আয় ও ভোগের (Consumption) এর একক। কেননা, বর্তমানে নগর সমাজের অনেক পরিবারেই স্বামী ছাড়াও স্ত্রী এবং তার বয়স্ক সন্তানসন্ততি ঘরের বাইরে কাজ করছে এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অর্থ উপার্জন করছে।
৫. বর্তমানে পরিবারে শিশুদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান অনেকটাই লোপ পেয়েছে। তবে পুরোপুরি নয়। পূর্বে পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে তা কিছুটা খর্ব হয়েছে। বর্তমানে এ দেশের পরিবারের নারীরা ক্রমশ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ঘরের বাইরে কর্মজীবী মহিলার সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উচ্চ শ্রেণির মেয়েরা সম্পত্তির মালিক হচ্ছে এবং নিম্ন শ্রেণির মেয়েরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে উপার্জন করছে। এরূপ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আধুনিক নারীর দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করছে।
৬.শুধু অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনই আধুনিক পরিবারে পরিলক্ষিত নয়, সমাজে নারী ও পুরুষের পদমর্যাদা নতুনভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। আর এসবের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
৭. ঐতিহ্যবাহী পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে যেসব কার্য পূর্বে সম্পাদিত হতো সেসবের অনেকটাই এখন আধুনিক পরিবারে সম্পাদিত হয় না। এসব কার্যসম্পাদনের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন- শিশুর জন্ম হয় হাসপাতালে, লালিতপালিত হয় সেবা সদনে, কিন্ডারগার্টেনে সে শিক্ষা লাভ করে এবং খেলার মাঠে সমবয়সীদের সাথে অবসরে বিনোদন করে। শুধু তাই নয়, আধুনিক পরিবারে আজকাল রান্নাবান্না ও কাপড়চোপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজও পরিবারের বাইরে সম্পন্ন করা সম্ভব। আমাদের সমাজে ইদানীং ঘরে প্রস্তুত খাবারের চেয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সম্প্রতি বাংলাদেশে পরিবার ব্যবস্থা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং জৈবিক দিক থেকে সুগভীর পরিবর্তনের সম্মুখীন। সমাজ পরিবর্তনে পরিবারের কাঠামো ও কার্যাবলিতে পরিবর্তন আসছে সন্দেহ নেই। তবে পরিবার যুগের চাহিদা অনুযায়ী তার রূপ বদলিয়ে নিচ্ছে এবং কাজের ধরন ও প্রকরণে পরিবর্তন আনছে।