“সমাজব্যবস্থার মধ্যেই সামাজিক সমস্যা অন্তর্নিহিত”- উক্তিটি তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, সমাজ থেকেই সামাজিক সমস্যার উৎপত্তি এই ধারণাটি সংক্ষেপে বর্ণনা দাও।
অথবা, বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যাসমূহের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক সমস্যার গতিপ্রকৃতি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক সম্পর্ক হল সমাজ জীবনের স্বাভাবিক সমস্যা। তাই এটি সমাজবিজ্ঞানের প্রধান
আলোচ্যবিষয়। মাঝে মাঝে সামাজিক সম্পর্ক অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে, যার ফলে সামাজিক ব্যাধির সৃষ্টি হয়। এতে
মানুষের অসন্তোষ ও দুঃখদুর্দশার সূত্রপাত ঘটে। কোন সমাজই সমস্যামুক্ত নয়। তবে সমাজভেদে ও একই সমাজে
যুগভেদে সামাজিক সমস্যার প্রকৃতিতে বিভিন্নতা দেখা দিতে পারে এবং সমস্যার তীব্রতায় হ্রাস-বৃদ্ধিও হতে পারে
আধুনিক শিল্পায়িত জটিল সমাজে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি সত্ত্বেও সামাজিক সমস্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং
সমস্যা জটিল থেকে মেটিলতর হচ্ছে।
সামাজিক সমস্য (Social Problem) : যে পরিস্থিতি সমাজের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি ও কল্যাণ বিরোধী, সে
পরিস্থিতিকে সামাজিক সমস্যা বলে। অতএব সেসব সমস্যার সমাধান কিংবা দূরীকরণ একান্তই প্রয়োজন । সমাজবিজ্ঞানী
ফ্র্যাঙ্ক ‘American Journal of Sociology’ তে ‘Social Problem’ নামক এক প্রবন্ধে সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞায়
বলেছেন, সামাজিক সমস্যা বলতে এমন একটি সামাজিক সমস্যা বা অসুবিধা কিংবা অসংখ্য লোকের অসদাচরণকে বুঝায়,
যাকে শোধরানো কিংবা দূর করা দরকার।
সমাজবিজ্ঞানী হর্টন এবং লেসলি তাঁদের ‘The Sociology of Social Problems’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,
সামাজিক সমস্যা বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বুঝায়, যা অবাঞ্ছিত এবং যার প্রতিকার সংঘবদ্ধভাবে করা উচিত।
কোন পরিস্থিতিকে সামাজিক বলা উচিত তা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করা প্রয়োজন। এক সমাজে যাকে সমস্যা
বলা হয় অন্য সমাজে তাকে সমস্যা বলে গণ্য করা নাও হতে পারে। তবে কতক সামাজিক সমস্যা সর্বজনীন ও স্থায়ী।
এটি ঐতিহাসিক রেকর্ড ও জরিপকার্য দ্বারা প্রমাণিত।
সমাজবিজ্ঞানী হর্টন ও লেসলি সামাজিক সমস্যার যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে সামাজিক
সমস্যার প্রকৃতি জানা যায়। যেমন-
১. সামাজিক সমস্যা এমন একটি অবস্থা যা সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে প্রভাবিত বা জর্জরিত করে।
২. এমনভাবে তা সমাজের উপর প্রভাব রাখে যে, সবাই তাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বা অনভিপ্রেত বলে বিবেচনা করে।
৩. সমাজবিজ্ঞানীরা যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে ঐ সম্পর্ক সমাধানের লক্ষ্যে কিছু করা যাবে বা করা হবে বলে মনে করে।
সামাজিক সমস্যা হল সামাজিক অসঙ্গতি দ্বারা সৃষ্ট। ফলে সামাজিক সমস্যা জানতে হলে সামাজিক অসঙ্গতি জানা
একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করা হয়। আর সামাজিক অসঙ্গতি হল আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রত্যয়।
সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন ও নিমকফ (Ogburn and Nimkoff) বলেছেন যে, “When the harmonious relationship between the various parts of culture is disturbed, social disorganization ensures.”
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম (Durkheim) সামাজিক অসঙ্গতি বলতে বিবেচনা করেছেন, “Social
disorganization as a state of disequilibrium and a lack of social solidarity or consensus among the
members of a society.”
অতএব, সামাজিক অসঙ্গতি বা সমস্যা সমাজের ক্ষুদ্রতর সংগঠনের বা সমাজের ক্রিয়াকর্মে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত
গোষ্ঠীর মধ্যকার সম্পর্ক, নৈতিকতা, দলবদ্ধ কাজ, সমন্বয় ও সম্পর্কের ভিত্তিগুলো ভেঙে দেয়। সামাজিক সমস্যা ব্যক্তির
আচরণের মধ্যে এবং সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে অবিন্যাস সৃষ্টি করে। ব্যক্তির আচরণ বা নৈতিকতা সবই সমাজের বিভিন্ন
সংগঠন নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করে থাকে। ফলে সামাজিক সমস্যাকে অসঙ্গতি বলাই শ্রেয়। এ হিসেবে অনেক
সমাজবিজ্ঞানী Social Disorganization বা সামাজিক অসঙ্গতিকে সামাজিক সঙ্গতি বা সংগঠনের (Social
Organization) বিপরীত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে এস.এ. কুইন (S.A. Queen),
ডব্লিউ.বি. বোডেনহোফার (W.B. Bodenhofer) এবং ই.বি. হর্পার (E.B. Horper) অন্যত।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক সমস্যা সমাজের ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্নিহিত। কেননা,
সমাজ ছাড়া মানবজাতি অস্তিত্বহীন। আর মানবজাতিকে ঘিরেই সামাজিক সমস্যা। সমাজবিজ্ঞানের মূল আলোচ্যবিষয় হল মানুষ ও তার কার্যাবলি। সামাজিক সমস্যাও হল মানুষ ও তার ক্রিয়াকর্মের ফলাফল। আজকাল মানুষ তার সামাজিক সমস্যাকে সার্থকভাবে মোকাবিলা করার জন্য অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে সামর্থ্য হয়েছে। সমাজে যেমন জটিল ও নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক তেমনি সমাধানেও নতুন দিক বের হচ্ছে। আশা করি, সমাজ একদিন সমস্যাকে বর্জন করে পরিমার্জিত আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।