সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লেখকের নবজীবনের যে প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে তা বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ অনুসরণে প্রাবন্ধিকের প্রত্যাশার ভাষাচিত্র অঙ্কন কর।
উত্তরঃ ভূমিকা :
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে নিজের আশিতম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পাঠ করার উদ্দেশ্যে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন। এ প্রবন্ধে লেখক ইউরোপীয় সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা ও তার মানবতাবিরোধী নিপীড়ন দর্শনে যেমন হতাশ হয়েছেন তেমনি আবার প্রাচ্য তথা ভারতবর্ষের জনসাধারণের নবজাগরণের প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছেন। প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজদের ক্ষমতা, মদমত্ততা ও আত্মম্ভরিতার দাপট শেষ হওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে বলে তিনি চরম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
লেখকের আত্মকথন : প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক আত্মকথনে বলেছেন যে, তাঁর বয়স আশি বছর পূর্ণ হওয়ায় তাঁর জীবননাট্যের বিস্তীর্ণতা সম্মুখে প্রসারিত। পূর্বদিগন্তে একদিন যে জীবন তাঁর শুরু হয়েছিল, পশ্চিমপ্রান্তে পৌঁছে সে জীবন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সমগ্র দেশের বিচ্ছিন্নতা প্রত্যক্ষ করে হতাশ হয়েছে। বিশাল মানববিশ্বের সাথে ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছিল। ইংরেজদের মাধ্যমে। তখন আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতিচর্চার প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য ছিল না। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য ভারতীয়দের মন ও মননে বিশাল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল বলে লেখক মনে করেন। তিনি নিজেও ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে ইংরেজ বন্দনায় মুখর ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।
ইউরোপীয় সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য : বিশ্বসাহিত্যে সে সময় বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা ছিল একান্তই কম। তাই ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও উপভোগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদগ্ধের পরিচয়। সে সময় বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে, শেক্সপিয়ারের নাটকের উৎকর্ষতায়, বায়রনের কাব্যের মহিমায় বিশ্বসংস্কৃতির দিনরাত্রি ছিল মুখরিত। ভারতবর্ষের বিদগ্ধ মানুষেরা সনাতনী সাহিত্যের নাগপাশ ছিন্ন করে ইংরেজি সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যাবলি আত্মস্থ করায় মগ্ন ছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এ দলভুক্ত হয়ে পাশ্চাত্য ভাবধারায় সাহিত্যচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য তখন আপন বৈশিষ্ট্যগুণে ভারতীয় সাহিত্যকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল।
ইংরেজদের ঔদার্য : বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংরেজ ও ইংরেজ সভ্যতার ঔদার্য ছিল সর্বজনবিদিত। লেখক ইংরেজ চরিত্রে মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তখন ভারতীয়রা স্বজাতির স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে দেয়া সত্ত্বেও তাদের অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির প্রতি অগাধ বিশ্বাস। সে বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে, এক সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা ভাবতেন যে ইংরেজরা তাদের ঔদার্যের কারণেই ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দান করবে। কারণ এ উৎপীড়িত জাতির ভরসার স্থল ছিল ইংল্যান্ড। ইংরেজ তার আপন ঔদার্যে এ বিশ্বাসের বীজ রোপণ করেছিল পরাধীন ভারতীয়দের উর্বর মনোজগতে।
লেখকের শ্রদ্ধাবোধ : ইংরেজ সভ্যতার ঔদার্যগুণে অভিভূত লেখক আন্তরিক শ্রদ্ধার সাথে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথ বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে বিখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান জন ব্রাইটের মুখ থেকে পার্লামেন্টের বাইরে কিছু বক্তৃতায় চিরন্তন ইংরেজের শাশ্বত বাণী শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেসব বক্তৃতায় হৃদয়ের যে ব্যাপ্তি ছিল তা তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছিল। তাছাড়া ইংরেজের যে সাহিত্য তাঁর মনকে পুষ্ট করেছিল মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতা শ্রদ্ধার বিষয়ই বটে। তার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজাতিস্বীকৃত।
লেখকের বিশ্বাসভঙ্গ : যখন লেখক ইংরেজ চরিত্রে সাম্রাজ্য মদমত্ততার উপকরণ প্রত্যক্ষ করলেন তখন তাঁর বিশ্বাসভঙ্গ ঘটল। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছিল রিপুর তাড়নায় তারা তাকে অনায়াসে লঙ্ঘন করে গেল। তাই নিভৃতে ইংরেজি সাহিত্যের রসসম্ভোগের বেষ্টন থেকে একদিন তিনি বেরিয়ে এলেন। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য তিনি প্রত্যক্ষ করলেন তা হৃদয়বিদারক। তিনি অনুভব করলেন, মানুষের জীবনধারণের যে অত্যাবশ্যক উপকরণ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা সেসব থেকে ভারতীয়রা বঞ্চিত। এমন বঞ্চনা আধুনিক শাসনচালিত অন্য কোন দেশে এমন প্রকট রূপে দেখা যায়নি।
লেখকের মোহমুক্তি : কৈশোর ও যৌবনে যে ইউরোপীয় সভ্যতার ঔদার্যে লেখক মোহাচ্ছন্ন ছিলেন জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে তিনি তার নগ্ন রূপটি প্রত্যক্ষ করে মর্মাহত হলেন। তিনি দেখলেন, যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ তার বিশ্বকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে তার যথার্থ ব্যবহার থেকে ভারতবর্ষ বঞ্চিত। অথচ একই যন্ত্রশক্তির সাহায্যে জাপানিরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। ইংরেজরা ভারতীয়দের পৌরুষ দলিত করে দিয়ে তাকে চিরকালের মত নির্জীব করে রেখেছে। অথচ এ দেশ ইংরেজকে বহুকাল ধরে ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। আর ভারতবর্ষ ইংরেজের সভ্য শাসনের জগদ্দল পাথর বুকে চেপে ধরে তলিয়ে রয়েছে নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে। ভারতীয়দের এ শোচনীয় দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে লেখকের মোহমুক্তি ঘটেছে।
রবীন্দ্রনাথের আশাবাদ : মোহমুক্তি ঘটার পর রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। কিন্তু সেদিন যে ভারতবর্ষকে তারা ফেলে যাবে তা এক লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনা স্তূপ মাত্র। তবুও ভেঙে পড়লে চলবে না। চুরম আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি তাই বলেছেন, “আজ আশা করে থাকব, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এ দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এ পূর্বদিগন্ত থেকেই।” অর্থাৎ তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, প্রাচ্যের এ দেশটি একদিন জেগে উঠবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে আপন ঐতিহ্যে মহিমান্বিত হবে।
নবজীবনের প্রত্যাশা : বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে নবজীবনের প্রত্যাশায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দিন একভাবে যাবে না। ইংরেজ শাসনের অবসান হবে অচিরেই। বিশ্বাস হারানোকে তিনি পাপ বলে মনে করতেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন, “মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এ পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হয়ে তার মহত্মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।” কারণ, “প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, ইউরোপীয় সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী নখাঘাতে জর্জরিত ভারতবর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, ভারতীয়দের নবজীবনের যে প্রত্যাশার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র ছয় বছর পর সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এবং ভারতীয়রা তাদের মর্যাদা ফিরে পেয়েছিল। লেখক নবজীবনের যে প্রত্যাশা করেছিলেন তা আজ ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে উঠেছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%ad%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%9f-%e0%a6%aa%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d/