প্রশ্না সনেট হিসেবে কবি আল মাহমুদের ‘ সোনালী কাবিন : ৫ ’ কবিতার সার্থকতা যাচাই কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম সার্থক স্রষ্টা । বিংশ শতাব্দীর জীবন – যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায় । আধুনিক সমাজ বাস্তবতার নিরিখে তিনি কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনে সার্থকতা দেখিয়েছেন । তাঁর কবিতায় প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়েছেন তিনি । কবি আল মাহমুদ কিছুসংখ্যক সার্থক সনেট রচনা করেও খ্যাতি অর্জন করেছেন । ‘
সোনালী কাবিন : ৫ ‘ তাঁর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার্থক সনেট । : সনেট কাকে বলে : সনেট আধুনিক ইংরেজি গীতি কবিতার একটি অত্যাধুনিক সংস্করণ । ইতালীয় কবি প্রেত্রার্ক সনেটের জনক । ইতালীয় শব্দ সনেটো ( Sonneto ) থেকে ‘ সনেট ‘ শব্দটি উদ্ভূত । ‘ সনেটো ’ শব্দটির অর্থ মৃদু ধ্বনি । একটি অখণ্ড ভাবকল্পনা যখন চৌদ্দ অক্ষরের ( মাত্রার ) পঙক্তিতে এবং চৌদ্দ পঙক্তির সীমাবদ্ধতায় একটি বিশেষ ছন্দরীতির অনুষঙ্গে বাণীবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয় , তখন তাকে সনেট বলা হয় । বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । সনেট কখনো কখনো চৌদ্দ মাত্রার সীমা অতিক্রম করলেও মাইকেল মধুসূদন তাঁর রচিত সনেটসমূহে এই মাত্রা অতিক্রম করেননি । পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় যারা সনেট রচনা করেছেন তাঁরাও মধুসূদনকে অনুসরণ করেছেন । বাংলায় সনেটকে বলা হয় চতুর্দশপদী কবিতা । ॥
সনেটের গঠন : পূর্বেই বলা হয়েছে চৌদ্দ মাত্রা সম্বলিত চৌদ্দ পঙক্তির কবিতাই সনেট । চৌদ্দ পঙক্তি আবার দুই ভাগে বিভক্ত । এর প্রথম আট পঙক্তিকে বলা হয় অষ্টক ( Octave ) এবং শেষ ছয় পঙক্তিকে বলা হয় ষটক ( Sestet ) । এই পর্ব দুটি অনুচ্ছেদতুল্য । প্রথম আট পঙক্তি অর্থাৎ অষ্টকে একটি ভাবের মুখবন্ধ রচিত হয় এবং শেষ ছয় পঙক্তিতে অর্থাৎ ষটকে তার উপসংহার টানা হয় । এই দুটি পর্ব মিলে একটি অখণ্ড কবিতা সৃষ্টি হয় যাতে কবির অনুভূতির পূর্ণতার প্রাপ্তি ঘটে । সনেট মন্ময় কবিতাগোষ্ঠীর অন্তর্গত । সনেটের ছন্দ ও মিল : সনেট অন্তমিলের কবিতা । তবে এর অন্তমিল পয়ার ছন্দের মতো নয় । সনেটের অন্তমিল সাধারণত কখখক , কখখক ; গঘঙ , গঘঙ কিংবা কখখক , কখখক ; গঘ , গঘ , গঘ হয়ে থাকে । ইংরেজ কবি শেকস্পিয়র এই অন্ত মিলের নিয়ম না মানলেও ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এবং মিল্টন এই নিয়ম মেনে চলেছেন । বাংলা ভাষায় যাঁরা সনেট রচনা করেছেন তাঁরা সকলেই একই নিয়ম অনুসরণ করেননি ।
সোনালী কাবিন : ৫ এর ছন্দ : কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘ সোনালী কাবিন : ৫ ‘ কবিতার ছন্দের ক্ষেত্রে মধুসূদনকে অনুসরণ না করে শেকসপিয়রকে অনুসরণ করেছেন । তাঁর এই কবিতার অন্তমিল নিম্নরূপ :
অষ্টক
কখ
কখ
গঘ
গঘ
ষটক:
ঙচ
ঙচ
ছছ
কবিতার আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য : ‘ সোনালী কাবিন: ৫ ‘ কবিতাটি চৌদ্দ মাত্রার রীতিকে অনুসরণ না করে চৌদ্দ পঙক্তির রীতি অবলম্বন করে রচিত । কবিতাটিতে একটি অখণ্ড ভাৰ ফুটে উঠেছে । অষ্টক ও ষটক মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা নির্মিত হয়েছে । কবিতাটিতে ভাবের গভীরতা ও ভাষার ঋজুতা বিদ্যমান ।
ভাবের অখণ্ড প্রবাহ : ‘ সোনালী কাবিন : ৫ ‘ কবিতায় প্রেম ও নিসর্গপ্রীতি সম্পর্কে কবির একান্ত অনুভূতি ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে আশ্রয় করে উপযুক্ত ও অপরিহার্য শব্দ সুষমায় অখণ্ডরূপে উপস্থাপিত হয়েছে । অষ্টক অংশে কবি তাঁর প্রেমভাবনা সম্পর্কে ইঙ্গিতপূর্ণ প্রস্তাবনার অবতারণা করেছেন । শরীরী প্রেমের প্রতি কবির আত্মনিষ্ঠ সমর্থন ও প্রেমের উদ্দামতা সম্পর্কে যে সরল স্বীকারোক্তি অষ্টকে ধ্বনিত হয়েছে , ষটকে এসে তার উপসংহার টানা হয়েছে । অষ্টক ও ষটক মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাবের মীমাংসা হয়েছে ।
মূলবক্তব্য : নিসর্গপ্রীতি , প্রেমভাবনা ও আত্মবোধের এক অনাবিল ভাব সমন্বিত কবিতা ‘ সোনালী কাবিন : ৫ ‘ । শরীরী প্রেমের স্বীকৃতি দিয়ে কবিতাটিতে বৈশ্বিক ভাবনার বিকাশ ঘটানো হয়েছে । প্রেমের অন্যতম প্রধান অবলম্বন যে শরীর এ কথা কবি নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন এই কবিতায় । কবি তাঁর দয়িতাকে প্রেম নিবেদন করেছেন লোকজ ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে । তিনি প্রেমের শিক্ষা নিয়েছেন নিসর্গ থেকে । তাঁর ভাষায়
“ নিসর্গের গ্রন্থ থেকে আশৈশব শিখেছি এ পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল । ”
দেহকে দেহ দিয়েই জয় করতে চেয়েছেন কবি । তাঁর মতে সর্বকালের সকল শিল্পীর মধ্যেই আছে এই প্রবণতা । সনেট হিসেবে সার্থকতা : ‘ সোনালী কাবিন : ৫ ‘ একটি সার্থক সনেট । এর পঙক্তিতে চৌদ্দমাত্রার রীতি না মানা হলেও তাতে কবিতার অঙ্গহানি ঘটেনি । এই কবিতায় আছে চতুর্দশ পঙক্তি । এর প্রথম আট পঙক্তি অর্থাৎ অষ্টকে বক্তব্যের সূচনা করা হয়েছে । এই অংশে প্রেম – ভাবনার একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যক্ত করা হয়েছে । কবিতাটির শেষ ছয় পঙক্তি অর্থাৎ ষটকে বক্তব্যের উপসংহার টেনে ভাবকল্পনার অখণ্ডতা বজায় রেখেছেন কবি । দুই পর্ব মিলে একটি অখণ্ড গীতিকবিতা নির্মিত হয়েছে অনায়াসে । সুতরাং গঠনরীতি , ছন্দ , অন্তমিল ও ভাবকল্পনার সমন্বয়ে ‘ সোনালী কাবিন : ৫ ‘ একটি সার্থক সনেট ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে , কবি আল মাহমুদের কবি প্রতিভার এক অক্ষয় নিদর্শন ‘ সোনালী কাবিন: ৫ ’ কবিতাটি । ভাব , ভাষা , গঠনরীতি ও আঙ্গিকের বিচারে এটি একটি সর্বাঙ্গসুন্দর সার্থক সনেট ।