কাজী আবদুল ওদুদের ‘ বাংলার জাগরণ ‘ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য বিশ্লেষণ কর।

প্রশ্ন কাজী আবদুল ওদুদ বিরচিত ‘ বাংলার জাগরণ ‘ প্রবন্ধের মূলবক্তব্য তোমার নিজের ভাষায় লিখ ।

উত্তর : কাজী আবদুল ওদুদ ( ১৮৯৪-১৯৭০ ) বাংলা সাহিত্যের একজন যুক্তিনিষ্ঠ ও মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে সুপরিচিত । মুক্তচিন্তা ও যুক্তিভিত্তিক রচনার জন্য বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন । ‘ বাংলার জাগরণ ‘ প্রবন্ধটি তথ্য সম্বলিত সমকালীন বাংলার সমাজ সংস্কৃতির দর্পণ স্বরূপ । বাংলার জাগরণের গতি – প্রকৃতিতে বিভিন্ন মনীষীর অবদান এ প্রবন্ধে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক উপস্থাপন করেছেন ।

জাগরণ বলতে আমরা বুঝি নিষ্ক্রিয় বা অচেতন অবস্থা হতে মুক্তি , উদ্দীপনা ও চেতনা লাভ । ‘ বাংলার জাগরণ ‘ প্রবন্ধে লেখক বাঙালির জাতীয় জীবনে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন মনীষী দ্বারা যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তাই বুঝিয়েছেন । অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে যে জাগরণের সূত্রপাত হয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়ে । ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির মনে ইউরোপীয় জ্ঞান – বিজ্ঞান – দর্শন বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে । বাংলার সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে তাদের বিশেষ ভাবনা ও কর্মপ্রচেষ্টাকে বাংলার জাগরণের সূত্রপাত বলে ধরা হয় ।

ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দীতে জাগরণের শুরু হলেও বাংলায় তা শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে । বাংলার জাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় । বাংলার জাগরণ শুরু হয় রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মচিন্তার ভিতর দিয়ে । পাশ্চাত্যের জাগরণ দ্বারা বাংলার জাগরণ পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হলেও তা শুধু ইউরোপের প্রতিধ্বনিমাত্র হয়নি । প্রবন্ধকার তার নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাজনা ও গোহত্যা নিয়ে হিন্দু মুসলমানদের দাঙ্গা পর্যন্ত আমাদের দেশের চিন্তা ও কর্মধারা , আর ডিইস্ট এনসাইক্লোপিডিস্ট থেকে আরম্ভ করে বোল্শেভিজম পর্যন্ত পাশ্চাত্য চিন্তা ও কর্মধারার দিকে তাকালে বোঝা যায় আমাদের জাতীয় চিন্তা ও কর্ম পরস্পরার ভিতর দিয়েই বাংলার জাগরণ শুরু হয় ।

রাজা রামমোহন রায় বাংলার জাগরণের অগ্রনায়ক । রামমোহনের নবচিন্তা ও ভাবধারার মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনে পরিবর্তন সূচিত হয় । রামমোহন ছিলেন বহু গুণের অধিকারী । একদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান , পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ অন্যদিকে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁর সৃষ্টি প্রেরণার অন্যতম উৎস । রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের মধ্যে দিয়ে সনাতন হিন্দুধর্মে নতুন ভাবধারার সূচনা হয় । রামমোহনকে তাই বাংলার জাগরণের ক্ষেত্রে ‘ প্রভাত সূর্য ‘ বলা হয় । ধর্মচিন্তা , শিক্ষাবিস্তার , সমাজসংস্কারের মতো হিতকরী কাজে রামমোহনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে শত বছরে বাংলায় এমন কোন কর্মীর জন্ম হয়নি । একেবারে আধুনিক কালের সমস্ত মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায় ।

বাঙালি না হয়েও বাংলার জাগরণে যে মানুষটি বিশেষভাবে স্মরণীয় তিনি হলেন হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক কবি ও চিন্তাবিদ ডিরোজিও । রামমোহন জাতীয় জীবনের যে সমস্ত কর্মের প্রবর্তন করেছিলেন তার মধ্যে হিন্দু কলেজ অন্যতম । ডিরোজিও এ হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন । এখানে মাত্র তিন বছর চাকরি করলেও তিনি তাঁর ছাত্রদের মাঝে নতুন আদর্শ ও চিন্তার এক দিগন্ত উন্মোচিত করে দেন । ডিরোজিওর প্রদর্শিত পথে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে শিক্ষিত একটি শ্রেণি গড়ে উঠে যাঁরা ইয়ংবেঙ্গলগোষ্ঠী নামে পরিচিত । ডিরোজিওর অনেক শিষ্যই চরিত্রবিদ্যা সত্যানুরাগ ইত্যাদির জন্য জাতীয় জীবনে গৌরবের আসন লাভ করেছিলেন ।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে জ্ঞানুনুরাগী ও সৌন্দর্যানুরাগী ছিলেন । বাংলার জাগরণে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গভীর ঈশ্বরপ্রেমের মাধ্যমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন । রামমোহনকে নিয়ে যত বাদানুবাদ হয়েছে তার মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার দত্তের বাদানুবাদই সুবিখ্যাত । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মত হলো রামমোহনের উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরপ্রেম প্রচার । আর অক্ষয়দত্তের মত হলো রামমোহনের উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান – বিজ্ঞানের প্রচার । দেবেন্দ্রনাথের পরম ব্রহ্মজ্ঞান তৎকালীন সমাজে প্রশংসিত হয়েছিল ।

অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন গভীরভাবে জ্ঞানপিপাসু । রামমোহনের শ্রেষ্ঠ দান কি বাংলাদেশে এ নিয়ে যে তর্ক – বিতর্ক হয়েছে সেখানে অক্ষয়কুমারের একটি বড় ভূমিকা আছে । তাঁর মতে রামমোহনের উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রচার । জ্ঞানুনুশীলন অক্ষয় কুমাররের কাছে এত বড় জিনিস ছিল যে এ ভিন্ন অন্য রকমের প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন না । জ্ঞানের আলোয় মানুষের চিত্তের মুক্তির জন্য অক্ষয়কুমারের অবদান অনস্বীকার্য ।

বাংলার জাগরণের ক্ষেত্রে অন্য কবি – সাহিত্যিকদের অবদান নিম্নে আলোচনা করা হলো : নবসাহিত্যের নেতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন অত্যন্ত উদারচেতা । জাতি ধর্ম ইত্যাদির সংকীর্ণতা যেন জীবনে ক্ষণকালের জন্যও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি ; আর এ উদারচিত্ত কবি ইউরোপের ও ভারতের প্রাচীন কাব্যকলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ যেভাবে অবলীলাক্রমে আহরণ করে তাঁর স্বদেশবাসীদের উপহার দিয়েছেন সে কথা বাঙালি চিরদিনই বিস্ময় ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে নিজেকে যেমন সমৃদ্ধ করেছিলেন তেমনি সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালির আত্মজাগরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় একজন শিল্পী ও স্বদেশপ্রেমিক । তাঁর সাহিত্যে কল্পনা বিলাসের পরিবর্তে ফুটে উঠেছে বাস্তবতার নানা চিত্র । তিনি সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন । তাঁর অমর কীর্তি ‘ আনন্দমঠে ‘ আমরা দেশের দুর্দশা মথিত রক্তাক্ত হৃদয়ের পরিচয় খুঁজে পাই । বঙ্কিমচন্দ্র শেষ পর্যন্ত শিল্পের ক্ষেত্রে থাকতে পারেননি । তিনি ধর্মের ক্ষেত্রে অবতরণ করেছিলেন । বাংলার জাগরণের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের সবচেয়ে বড় অবদান জাতিকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করা । তবে দেশের সকলশ্রেণীর মানুষের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র শেষ পর্যন্ত একই সুরে কথা বলতে পারেননি । সেই জন্য শেষ পর্যন্ত জাতির ত্রাণকর্তার বড় আসনটি জাতি তাঁকে দিতে পারেনি ।

বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তার যে রূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার সংকীর্ণতা ভেঙে তাকে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হয়েছেন । কিন্তু তাঁর আদর্শের অনুপ্রেরণা এ পর্যন্ত বাংলার জাতীয় জীবনে কমই অনুভুত হয়েছে । কেননা রবীন্দ্রনাথ কবি , তাও আবার সূক্ষ্ম শিল্পী গীতিকবি ; তাই যে মহামানবতার গান তিনি গেয়েছেন আমাদের স্কুল প্রকৃতির জনসাধারণের জীবনে কত দিকে তার স্পন্দন জাগবে তা ভেবে পাওয়া দুষ্কর । তবুও আমরা বলতে পারি রবীন্দ্রনাথের বিপুল কর্মযজ্ঞ বাঙালি চিত্তে গভীরভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে ।

বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রিয় শিষ্য ছিলেন । পরবর্তীতে তিনি মুক্তির বাণী নিয়ে সারা বিশ্বে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দিকগুলো তুলে ধরেন । বিবেকানন্দকে নিয়ে সমালোচনা থাকলেও মোটের উপর তিনি একজন সত্যিকার স্বদেশ প্রেমিক ও মানবপ্রেমিক ছিলেন । সেবাশ্রম প্রভৃতি সূচনা করে জাতীয় জীবনে তিনি যে বৃহত্তম কর্মক্ষেত্র রচনা করেছেন জাতির চিত্তপ্রসারের জন্য বাস্তবিকই তা অমূল্য । তাঁর আদর্শ এবং প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলার হিন্দু যুবককে দেশের সত্যিকার সন্তান হতে অনেকখানি সাহায্য করেছে সন্দেহ নেই ।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি বাংলার জাগরণ একটু দেরিতে শুরু হলেও বিভিন্ন মনীষীর চিন্তা – চেতনায় তা জনগণের মাঝে দ্রুত প্রসার লাভ করে । নবজাগরণের প্রভাত নক্ষত্র রামমোহন রায় ধর্মের ক্ষেত্রে যে নতুন ভাবধারা সূচিত করেছিলেন কালের পরিক্রমায় তাই – ই সমাজের সর্বস্তরে নতুন ভাবনা , নতুন পথের সন্ধান এনে দেয় ।