সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
অথবা, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল কী ভূমিকা পালন করে থাকে? আলোচনা কর।
অথবা, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট গৃহীত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রা শুরু হয়। যেকোনো সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বিরোধী দল হলো রাষ্ট্রের ‘Sadow Government
অর্থাৎ, ‘ছায়া সরকার’ । সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে বিরোধী দল দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো সুষ্ঠু ও কার্যকরী বিরোধী দল । কেননা বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমেই সংসদীয় সরকারের সফলতা নির্ভর করে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা : আধুনিক যুগে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে সুষ্ঠু বিরোধী দল। কেননা বিরোধী দলের উপযুক্ত ও গঠনমূলক সমালোচনা ও সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ ছাড়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল হতে পারে না। ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিরোধী দলের ভূমিকা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। নিম্নে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা তুলে ধরা হলো :
১. গঠনমূলক সমালোচনা : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার সঠিক পথে চলতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আমিনুর রহমানের মতানুসারে, “বিরোধী দলের প্রধান ভূমিকা হলো সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা।”
২. জনমত গঠন : বিরোধী দলের অন্যতম কাজ হলো সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা এবং সরকারের ত্রুটিসমূহ জনসমক্ষে তুলে ধরা। যার ফলে সরকার তার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
৩. সংসদীয় ব্যবস্থাকে সচল রাখা : বিরোধী দল সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থাকে সচল রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, বিরোধী দল সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে।
৪. বিকল্প কর্মসূচি পেশ : বিরোধী দল জনগণের সামনে সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি বিকল্প কর্মসূচি প্রণয়ন করে, যাতে জনগণ সঠিক কর্মসূচি বেছে নিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে পারে ।
৫. সরকারের নিয়ন্ত্রণ : সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই বিরোধী দলের উপর নির্ভরশীল। সংসদীয় গণতন্ত্রের নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব থাকলেও তারা পরোক্ষ। মূলত প্রত্যক্ষভাবে সরকারে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিরোধী দলেই কার্যকর ভূমিকা রাখে । বিরোধী দলের চাপের মুখেই সরকার বিভিন্ন তদন্ত কমিটি বা কমিশন গঠন করে ।
৬. সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ : সরকারি দল বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে স্বৈরাচারী হতে পারে না। বিরোধী দল সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রুদ্ধ করে। জাপানে বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনার মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কিচিমায়াজাওয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় ।
৭. সমস্যা বিধান ও প্রতিকার নির্দেশ : দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সমস্যা নির্ধারণ ও তার প্রতিকারের সঠিক উপায় নির্ধারণ করে বিরোধী দল সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
৮. জাতীয় ঐকমত্য গঠন : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল জাতীয় সংহতি বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট থাকে। এজন্য জাতি-ধর্ম ও বর্ণগত স্বার্থ নির্বিশেষে বিরোধী দলগুলো দলীয় নীতি ও কর্মসূচি প্র ণয়ন করে।
৯. শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ক্ষমতা প্রবর্তন : নির্বাচনে জয়লাভ করলে বিরোধী দল মূলত সরকার গঠনের সুযোগ পায়। ফলে, শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে সরকার ক্ষমতা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ছাড়তে বাধ্য হয়।
১০. বিকল্প সরকার : বিরোধী দল হচ্ছে বিকল্প সরকার। ‘ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো দুর্বলতা দেখা দিলে বিরোধী দল বিকল্প সরকার গঠনের পরিকল্পনা করে। বর্তমানে বিকল্প ধারার সরকারের কথা এখানে উল্লেখ্য ।
১১. গণতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত : গণতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত হিসেবে বিরোধী দল বিশেষ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো গোলযোগ দেখা দিলে শক্তিশালী বিরোধী দল তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা করে থাকে।
১২, জনগণকে সচেতন করা : বিরোধী দল জনগণকে সচেতন করে তোলে। সরকারি দলের কাজ হলো নীতিনির্ধারণ ও তা প্রয়োগ। এসময় বিরোধী দল সরকারের ত্রুটি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলে ।
১৩. আইন প্রণয়নে সহায়তা করা : জনগণের স্বার্থে রচিত আইনগুলোকে বাস্তবে রূপদানের জন্য বিরোধী দলেরত সাহায্য ও সহযোগিতা করা।
১৩. দরিদ্র প্রার্থীদের সহায়তা করা : সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সামর্থ্যের অভাবে দরিদ্র এবং মেধাবী প্রার্থীগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলো তাদের সার্বিক সহায়তা করে থাকে।
১৫. রাজনৈতিক শিক্ষাবিস্তার : রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার বিস্তার ঘটায়। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, পত্রিকা এবং বিবৃতি প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে বিরোধী দলগুলো রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটায় ।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে বিরোধী দল। কারণ বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা এবং অন্যায়ের বিরোধিতার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সব সময়ই এর বিপরীত চিত্র ফুটে ওঠে যা দেশের জন্য হতাশাব্যঞ্জক।