প্রশ্নঃ লেনদেন ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণ বর্ণনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো রপ্তানিনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধি , রপ্তানি বহুমুখীকরণ , শিল্পের প্রসারে আমদানীকৃত উপাদান সহজলভ্য করাসহ বৈদেশিক বাণিজ্যে দেশের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি রপ্তানির মধ্যে অনুকূল ভারসাম্য বজায় রাখা । প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য , বাণিজ্যে উদারীকরণ এবং রপ্তানিনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ।
লেনদেন ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণ : নিম্নে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের প্রতিকূলতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. বৈদেশিক দেনা পরিশোধ : কোন দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করলে সে ঋণের আসল ও সুদ বাবদ বাংলাদেশকে প্রচুর টাকা পরিশোধ করতে হয় । এটিও লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ ।
২. মুদ্রাস্ফীতিজনিত কারণ : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণে লেনদেন ভারসাম্যের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় । নানা কারণে এদেশের মুদ্রাস্ফীতি ঘটে থাকে এবং মূল্যস্তর বৃদ্ধি পায় । এর ফলে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন হ্রাস পায় , বিনিয়োগ কমে যায় এবং পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় ।
৩. আমদানিজনিত মূল্যবৃদ্ধি : যেসব পণ্যসামগ্রী আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি তার আমদানিজনিত ব্যয় পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । তাছাড়া বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় লেনদেন ভারসাম্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে ।
৪. রপ্তানি পণ্যের নিম্নমূল্য : বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ এবং যাবতীয় রপ্তানি দ্রব্যের বেশিরভাগ কৃষিজাত দ্রব্য ও কাঁচামাল স্বাভাবিকভাবেই শিল্পজাত দ্রব্য হতে এর মূল্য কম । ফলে রপ্তানি আয় কম এবং লেনদেন ভারসাম্যের প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করে ।
৫. ৰাণিজ্য শর্তের প্রতিকূলতা : বাংলাদেশের রপ্তানিজাত পণ্য নিতান্তই কম । পক্ষান্তরে , এসব দ্রব্যের চাহিদা বিশ্ব বাজারে স্থিতিস্থাপক বিধায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকূল বাণিজ্যিক শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় । তাই লেনদেন ভারসাম্য দেখা দেয় ।
৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : এদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রায় লেগেই থাকে । হরতাল , ধর্মঘট ও কর্মবিরতি ইত্যাদি কারণে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন ও বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পায় । এর ফলে রপ্তানি হ্রাস পায় কিন্তু আমদানি অপরিবর্তনীয় থাকে , কখনো কখনো বৃদ্ধি পায় ।
৭. মূলধনী দ্ৰব্য আমদানি : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় দ্রুত শিল্পায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকার মূলধনী দ্রব্য যেমন- যন্ত্রপাতি , মেশিন ও রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করতে হয় । এজন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি দেখা যায় ।
৮. শর্তযুক্ত ঋণ ব্যবস্থা : বাংলাদেশ দাতা দেশগুলোর কাছ থেকে কঠোর শর্তসাপেক্ষে ঋণ গ্রহণ করে থাকে । ফলে বাংলাদেশের ছোট অর্থনীতির উপর মাত্রারিক্ত চাপ পড়ে এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি সৃষ্টি হয় ।
৯. দেশীয় সংরক্ষণ নীতি : প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব শিল্প সংরক্ষণে সদা তৎপর এর ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে লেনদেন ভারসাম্য ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ।
১০. যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় , কলে উৎপাদন হ্রাস পায় । অপরপক্ষে , যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রচুর পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় , ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয় ।
১১. অদৃশ্য খাতে অধিক ব্যয় : বাংলাদেশের অদৃশ্য খাতে অধিক ব্যয়ের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয় । বিদেশে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের খরচ , বৈদেশিক বিশেষজ্ঞের বেতন , বিদেশি জাহাজ ও প্লেন ভাড়া প্রভৃতি কারণে অদৃশ্যমান খাতে এদেশকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয় ।
১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশের জলবায়ুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য নাতিশীতোষ্ণ । ফলে এদেশে বন্যা , ঝড় , অতি বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর কারণে উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয় তেমনি প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ঘাটতি হয় । ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে যার আমদানি করতে হয় । তাই লেনদেন ভারসাম্য এদেশের প্রতিকূলে যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , লেনদেন ভারসাম্যের প্রতিকূলতা যদিও বাংলাদেশের জন্য কাম্য নয় , তবুও নানাবিধ কারণে লেনদেন ভারসাম্যহীনতা এদেশকে মস্তবড় খাদের মধ্যে আটকে রেখেছে এবং ভারসাম্যহীনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে এবং আমদানি ব্যয়ও হ্রাস করতে হবে । তাহলেই লেনদেনের ঘাটতিজনিত সমস্যা দূরীভূত হবে এবং ভারসাম্যে উপনীত হবে ।