লিপিবদ্ধকরণের প্রকারভেদ আলোচনা কর।

অথবা, কেইস লিপিবদ্ধকরণ/ কেইস সংরক্ষণ- এর প্রকারভেদ লিখ।
অথবা, লিপিবদ্ধকরণের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, রেকডিং এর শ্রেণিবিভাগ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাহায্যার্থী সম্পর্কে কি কি বিষয় লিপিবদ্ধ করতে হয় এবং কখন ও কোন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করতে হয় তা অনেকটা ব্যক্তি ও তার সমস্যার প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। তবে কিছু কিছু সাধারণ বিষয় আছে, যা অবশ্যই লিপিবদ্ধকরণ করতে হয়।
লিপিবদ্ধকরণের প্রকারভেদ : লিপিবদ্ধকরণের ধরনকে মোটামুটি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হলো :
১. বর্ণনামূলক লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি (Narrative Recording Style);
২. সংক্ষিপ্ত লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি (Summarized Recording Style) এবং
৩. ব্যাখ্যাধর্মী লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি (Interpretative Recording Style)।
১. বর্ণনামূলক লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি (Narrative Recording Style) : সমাজকর্মীর সাথে সাহায্যার্থীর প্রথম সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে সাক্ষাৎকার অধিবেশনের সকল স্তরে সাক্ষাৎকারের প্রতিটি পর্যায়ের বিষয়বস্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রাখার পদ্ধতিকে বর্ণনামূলক লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি বলা হয়। এ প্রক্রিয়া অনেকটা মুক্ত ও নমনীয় প্রকৃতির। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যাবলি নিম্নরূপ :
ক. এ পদ্ধতিতে সমাজকর্মীকে বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যাবলিকে বর্ণনামূলক নথিতে লিপিবদ্ধ করেন;
খ. এ প্রক্রিয়া অনেকটা দৈনন্দিন ডায়েরি লিপিবদ্ধ করার মত;
গ. বর্ণনাত্মক নথিপত্র যেভাবে লিপিবদ্ধ করতে হয় এ পদ্ধতি অনেকটা সে রকম।বর্ণনামূলক লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে কতকগুলো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। যেমন-
ক. লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজকর্মীকে নোটবুক ব্যবহারের নীতি ও কৌশল অনুসরণ করতে হয়;
থ. সময়ের অপচয় যাতে না হয় সেদিকে সমাজকর্মীকে খেয়াল করতে হয়;
গ. সমাজকর্মীকে সহজ সরল ভাষা লিপিবদ্ধ করতে হয়;
ঘ. অর্থপূর্ণ বাক্য ও প্রতীকী শব্দ সুস্পষ্টভাবে ব্যবহার করতে হয়;
ঙ. সমাজকর্মীকে গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করতে হয়;
চ. সমাজকর্মী যখন ঘটনাটি সম্পর্কে পুরোপুরি স্বচ্ছ ধারণা পাবেন তখনই তিনি লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করবেন।
২. সংক্ষিপ্ত লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি (Summarized Recording Style) : সংক্ষিপ্ত লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়া বলতে লিপিবদ্ধকরণের সেই প্রক্রিয়াকে বুঝায় যাতে সেবাগ্রহীতার সমস্যার সঠিক তথ্য সংক্ষিপ্তাকারে, সুনির্দিষ্টভাবে ও ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এ পদ্ধতির সুবিধা হলো সমাজকর্মীর সময় ও শ্রম বাঁচে।
Dictionary of Social Work-এ এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “Narrative summary is a system of social case work recording in which the social worker describes and consolidates all the relevant nformation obtained about the client system, the progression of the intervension, including procedures used out come, and the interim and concluding progress and recommendations.”
৩. ব্যাখ্যাধর্মী লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি (Interpretative Recording Style) : সাক্ষাৎকার চলাকালীন যে লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চলে তা অসম্পূর্ণ ও সংক্ষিপ্ত হতে পারে। সে কারণে সাক্ষাৎকার শেষে লিপি’র যথার্থ ব্যাখ্যাদান করতে হয়। এতে ঘটনা সহজেই বুঝা যায় এবং ঘটনার দুর্বোধ্যতা দূর হয়। ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রেকর্ড স্টাইলে সংযুক্ত করতে হয়। সমাজকর্মে ব্যাখ্যাধর্মী লিপিবদ্ধকরণ পদ্ধতি একটি বিশেষ তাৎপর্য বর্ণনা করে। এ প্রসঙ্গে Gordon Hamilton, “A record is not a professional document nor is it entirely a reliable document, if there is no social interpretation there in.” অর্থাৎ, লিপিবদ্ধকরণের বিষয়বস্তুর মধ্যে যদি সামাজিক ব্যাখ্যা প্রদান না করা হয় তাহলে তা পেশাগত দলিল বা সার্বিক নির্ভরযোগ্য দলিলে পরিণত হয় না।লিপিবদ্ধকরণের উপর্যুক্ত তিন প্রকার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি ছাড়াও আরও কতকগুলো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি রয়েছে। যথা :
১. অনুপুঙ্খ লিপিবদ্ধকরণ (Verbatim Recording) : অনুপুঙ্খ লিপিবদ্ধকরণ লিপিবদ্ধকরণের এমন একটি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি যে পদ্ধতিতে ব্যক্তি ও তার সমস্যার সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয় অক্ষরে অক্ষরে লেখা হয়। এরূপ ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বের করা প্রতিটি কথা, ব্যক্তির প্রকাশভঙ্গি, ইঙ্গিত, বাচনিক ভঙ্গি, কথা বলার ধরন, বিরক্তি ভাব, হাসি, সুখদুঃখের ছাপ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই লেখা হয়।
Dictionary of Social Work এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Verbatim recording is the social case work record, the process of writing down every word said in the interview and to the extent possible,every gesture, expression and tonal inflection so that the meaning is accurately conveyed.”
এ প্রক্রিয়ার একটি অসুবিধা রয়েছে, কারণ এ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হলে সুষ্ঠু সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
২. সমস্যাকেন্দ্রিক লিপিবদ্ধকরণ (Problem Oriented Record) : সমস্যাকেন্দ্রিক লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়া বিভিন্ন পেশাদার ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত চার প্রকার বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। যথা :
ক. সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন তথ্যাদি;
খ. সমস্যা প্রয়োজনানুযায়ী চিহ্নিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি সমস্যার পৃথক ক্রমিক নম্বর দান;
গ. তালিকাভুক্ত চিহ্নিত সমগ্র সমাধানের সম্ভাব্য পদক্ষেপ
ঘ. পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাবলি।
৩. ব্যক্তিকেন্দ্রিক লিপিবদ্ধকরণ (Person Oriented Recording) : Social Work Dictionary (1995) অনুযায়ী, “Person oriented record is a formal used by some social workers and some social agencies to keep specific, accountable and goal directed record of the intervention for each client. It ontains an initial database, treatment plan assessment, progress notes and the progress review.”
৪. সোপ ফরম্যাট মেথড (SOAP Format Method) : এ ধরনের পদ্ধতি সমাজকর্মী, চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য পেশার লোকজন ব্যবহার করেন। লিপিবদ্ধকরণের এ প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি ‘SOAP’ নামে আদ্যক্ষর অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যস্ত।SOAP Format এ SOAP এর চারটি অক্ষর চারটি অর্থ প্রকাশ করে। যথা :
ক. S = Subjective information (আত্মনিষ্ঠ তথ্যাদি);
১. O = Objective information (বস্তুনিষ্ঠ তথ্যাদি);
গ. A = Assessment (মূল্যায়ন) ও
ঘ. P = Plan (পরিকল্পনা)।
ক. আত্মনিষ্ঠ তথ্যাদি (Subjective information) : এক্ষেত্রে দু’ধরনের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। যথা :
i. সাহায্যার্থী কর্তৃক প্রকাশিত লক্ষণাদি ও
ii. সাহায্যার্থীর পরিবার কর্তৃক প্রকাশিত লক্ষণাদি।
খ. বস্তুনিষ্ঠ তথ্যাদি (Objective information) : এ ধরনের তথ্যের মধ্যেও দু’ধরনের তথ্য উল্লেখযোগ্য। যথা :
i. সামাজিক তথ্যাদি ও
ii. জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্যাদি।
সামাজিক তথ্যাদির মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা ইত্যাদি। জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্যাদির মধ্যে রয়েছে পরিবারের জনসংখ্যা, বিবাহিত জনসংখ্যা, শিশুর সংখ্যা, বয়সভিত্তিক জনসংখ্যা, নারী ও পুরুষের সংখ্যা ইত্যাদি।
গ. পরিকল্পনা (Plan) : এক্ষেত্রে যেসব তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতে হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :
i. পেশাদার ব্যক্তি বা এজেন্সি কি ধরনের সেবা প্রদান করবে;
ii. সমস্যা সমাধানের জন্য কি কি উপকরণ আছে;
iii. কিভাবে সাহায্যার্থীকে সেবা প্রদান করা হবে ইত্যাদি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, ব্যক্তির সমস্যার ধরন ও ব্যক্তিত্বভেদে বিভিন্ন বিষয় সমাজকর্মীকে লিপিবদ্ধ করতে হয়। লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে সমাজকর্মী ব্যক্তির সমস্যার সমাধান বিষয়ে এবং তার সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ে একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেন।লিপিবদ্ধকরণের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে সমাজকর্মীর ভালো ধারণা থাকলে সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। যেহেতু সকল ক্ষেত্রেই লিপিবদ্ধকরণের উদ্দেশ্য হলো সুশৃঙ্খল ও কার্যকরভাবে সেবা সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য ব্যক্তি ও তার সমস্যাকে যথাযথভাবে অনুধ্যান এবং সে আলোকে সেবা কার্যক্রম গ্রহণ-বাস্তবায়ন করতে সঠিক দিকনির্দেশনা লাভ।