রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে টীকা লিখ ।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতীচ্যের শিক্ষাদর্শনকে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয় বলে প্রাচ্যের অনেক দার্শনিকই শিক্ষাদর্শনকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন। এদের মধ্যে অন্যতম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাদর্শনকে তিনটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদে ব্যাখ্যা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন : নিম্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
ক. প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন : দর্শনের জনক থেলিস প্রাকৃতিক বস্তু পানিকে জগতের মূল উপাদান বলে ঘোষণা করার ফলে আমরা তাঁকে প্রকৃতিবাদী বলি। পাশ্চাত্য দর্শনের সবচেয়ে প্রাচীন ধারা হচ্ছে প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতিবাদীদের পুনরুত্থান ঘটে সতেরো এবং আঠারো শতকে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে। প্রকৃতিই হচ্ছে সমগ্র সত্তা। প্রকৃতিবাদের মূল
উদ্দেশ্য হলো স্বভাবগত বিকাশকে সাহায্য করা। আর এ বিকাশ হবে প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতি অনুযায়ী। এটিই প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনের মূল বক্তব্য। প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হার্বার্ট স্পেন্সার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ
করেন। যথা :
১. শিক্ষা অবশ্যই শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করবে।
২. শিক্ষা শিক্ষার্থীর স্বতঃপ্রণোদিত সক্রিয়তাকে ব্যবহার করবে।
৩. শিক্ষা হবে আনন্দময়।
৪. শিক্ষা হবে আরোহাত্মক।
৫. শিক্ষা হবে দেহ ও মনের জন্য এবং
৬. শাস্তিগুলোকে হতে হবে ভুল কাজের স্বাভাবিক পরিণতি সংবলিত। প্রকৃতিবাদের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিবাদী। আবার ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণে ও শিক্ষার প্রকৃতি নির্ধারণেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতিবাদী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জীবনের শুরুতে বিকৃতির সমস্ত কৃত্রিম কারণ থেকে
স্বভাবকে প্রকৃতিস্থ রাখা খুবই দরকার। এ অবস্থা শিশুদের জন্য সুখের অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ শহরের শিক্ষাকে অস্বীকার
করেন। তিনি বলেছেন, কাজের ঘূর্ণির মধ্যে ঘাড়মুড় ভেঙে পড়ার আগে শিখবার সময়, বেড়ে উঠার সময় প্রকৃতির সহায়তা
একান্তভাবে প্রয়োজন। অগ্নি, জলবায়ু, স্থলকে মনের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেখতে শেখাই প্রকৃত শেখা।
খ. ভাববাদী শিক্ষাদর্শন : ভাববাদী শিক্ষাদর্শনের মূলকথা হলো মানুষের আত্মিক শক্তি ও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর উচ্চ মর্যাদা আরোপ এবং তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে পরিস্ফুট করে সত্যিকার অমৃতরূপের উন্মোচন। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন ভাববাদী। শিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মনের স্থান দিয়েছেন অতি উচ্চে। তিনি বলেন, শিক্ষা জীবনের সাথে সংগতিহীন একটা কৃত্রিম জিনিস নয়, আমরা কি হব ও কি শিখব, এ দুটি কথা গায়ে গায়ে
লাগানো। রবীন্দ্রনাথ মনুষ্যত্বের স্বাধীন উচ্চ অঙ্গের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার পক্ষপাতী। তিনি তাই বলেছেন, মানুষকে নিজের সকল মনুষ্যত্বকে অপরিমেয় বিকাশের দিকে নিয়ে যেতে হবে। মানুষ নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্যই পথ চলছে। তাই মানুষ নিজেকে বিশুদ্ধ করে, প্রবল করে, পরিপূর্ণ করে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছে। শিক্ষা হবে আত্মবোধের,
আত্মোপলব্ধির লক্ষণ। প্রকৃত মানুষ বলতে যা বুঝি আমাদের শিক্ষাও সে অনুযায়ী আদর্শসম্পন্ন হতে হবে। আদর্শকে খণ্ডিত করে নয়, সমগ্রভাবে শিক্ষার্থীর সম্মুখে উপস্থিত করতে হবে তার শিক্ষার শুরু থেকেই। শিক্ষার লক্ষ্যকে তিনি নির্ধারণ করেছেন পরমাত্মার সাথে মিল হওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠার প্রচেষ্টা হিসেবে। তাই তিনি বলেছেন, অসত্য
ছড়িয়ে আছে, তোমার সাথে মিললে তবে সত্য হব। তোমার সাথে সত্যের মিলন হবে, জ্ঞানের জ্যোতিতে মিলন হবে, মৃত্যুর পথ মাড়িয়ে অমৃতলোকে মিলন হবে।
গ. প্রয়োগবাদী শিক্ষাদর্শন : প্রয়োগবাদী শিক্ষাদর্শনের মূলকথা হলো শিক্ষায় সক্রিয়তার সুযোগ বিধান এবং বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীর মনকে যেমন সক্রিয় রাখতে চেয়েছেন, তেমনি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেও সক্রিয় রাখতে চেয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীর ইন্দ্রিয়কে সজাগ ও সক্রিয় রাখার কথা বলেছেন এবং জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ নির্ভর করতে চেয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন, প্রত্যক্ষ বস্তুর সংস্রব ছাড়া জ্ঞান, ভাব, চরিত্র, সবই
নির্জীব ও নিষ্ফল হতে থাকে। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদেরকে অল্প অল্প করে শেখাতে হবে এবং তারা যতটুকু শিখবে ততটুকুই প্রয়োগ করতে শিখবে। এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োগধর্মিতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সমাজের সাথে বিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ সামাজিক জীব, তাই সামাজিক কিছু রীতি রয়েছে। আর বিদ্যালয়ের বাস্তব পরিমণ্ডলে শিক্ষার্থীকে এসব রীতি পালনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যও এমন ছিল। রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস করতেন, নিজে চিন্তা করে এবং হাতেকলমে কাজ করে যে জ্ঞান অর্জন করা যায় সে জ্ঞানই প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশকে নিশ্চিত করতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাক্ষেত্রে যে মতবাদ দিয়েছেন তা প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য অনিবার্য। তিনি জ্ঞান লাভের সকল প্রচেষ্টাকে ‘সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ আদর্শরূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি শিক্ষাদর্শনে যে প্রকৃতিবাদী, ভাববাদী, প্রয়োগবাদী মতবাদ প্রকাশ করেছেন তা থেকে বলা যায়, তিনি আসলে সমন্বয়বাদী মতবাদ দিয়েছেন। তাঁর এ শিক্ষাদর্শন বর্তমান বিশ্বে উন্মোচন করেছে এক নতুন দিগন্তের। জ্ঞানের কোনো শাখাই এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ সত্যকে লাভ করতে পারেনি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজন এমন একটি আদর্শ, যা যুগের সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গি বহন করবে। জোরালো কণ্ঠে তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন ঐ প্রয়োজন মিটাতে পেরেছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।