অথবা, মুসলিম লীগের শাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম সম্পর্কে যা জান লিখ ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯০৬ সালে ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল।
মুসলমান সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া উত্থাপন করার একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে মুসলিম লীগ। মুসলিম জাতীয়তাবাদের পক্ষে জনসমর্থন তৈরিতে এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরবর্তী ২৫০টি আসনের মধ্যে ১১৪টি আসন অর্জন করে। কিন্তু মুসলিম লীগের জনবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড
পরাজয় ডেকে আনে এবং দলটির জনপ্রিয়তায় ধস নামে।
মুসলিম লীগের শাসন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম : ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলিম
আসনসমূহের ৯৭% আসনে বিজয়ী হয়। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের দু’বছরের মধ্যে মুসলিম লীগ জনসমর্থন হারাতে শুরু করে। মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলন শুরু হয়। নিচে তা বর্ণনা করা হলো :
১. অগণতান্ত্রিক আচরণ : মুসলিম লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অগণতান্ত্রিক আচরণ শুরু করে। মুসলিমের
অগণতান্ত্রিক আচরণের শিকার হয় সোহরাওয়ার্দী। মুসলিম সরকার তাকে অগণতান্ত্রিকভাবে বহিষ্কার করে। পূর্ব বাংলার সোহরাওয়ার্দী সমর্থকরা কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের এরূপ নেতৃত্ব সহজে মেনে নিতে পারেনি। তারা মুসলিম লীগের বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
২. মুসলিম লীগ পকেট সংগঠনে পরিণত : মুসলিম লীগ দলের মধ্যে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ খাজা নাজিমুদ্দিন এবং নুরুল আমিনের পকেট সংগঠনে পরিণত হয়। ফলে তাদের স্বৈরাচারী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ এবং ১৯৫১ সালের
এপ্রিল মাসে সরকার বিরোধী যুব সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’ গঠিত হয়। এসব সংগঠন ফ্যাসিস্ট মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
৩. রক্ষণশীলতা : মুসলিম লীগ রক্ষণশীল সংগঠনে পরিণত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন ও নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন বাংলার মুসলিম লীগ ছিল গণবিচ্ছিন্ন। মুসলিম লীগের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশকে সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। মুসলিম লীগ এবং লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুরু করে পূর্ব বাংলার তরুণ সমাজ।
৪. গণবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ : ক্ষমতা গ্রহণের পর পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতৃত্ব আসে খাজা নাজিমুদ্দীন ও নুরুল আমিনের হাতে। এরা ছিল গণবিচ্ছিন্ন নেতা। বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে মুসলিম লীগ সরকার অগণতান্ত্রিক পথে হাঁটতে থাকে।
৫. ভাষা আন্দোলন : রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগ সরকার চক্রান্ত শুরু করে। তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রাম ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে ৭.২% লোকের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
৬. আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন : মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী একটি কার্যকরী বিরোধী দল – হিসেবে আবির্ভূত হয় ।
৭. উপনির্বাচন ও নির্বাচন নিয়ে চক্রান্ত : মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পায়। ফলে মুসলিম লীগ নিশ্চিত
পরাজয় জেনে নির্বাচন নিয়ে তালবাহানা শুরু করে। বিভিন্ন অজুহাত ও আইনের কথা বলে প্রাদেশিক আইনসভার মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধি করে, যা পূর্ব বাংলার জনগণ মেনে নেয়নি। তারা গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুরু করে।
৮. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন : পূর্ব বাংলার জনগণ মুসলিম লীগকে মোক্ষম জবাব দেয়, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম
লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুসলিম লীগের দমননীতি প্রতিবাদস্বরূপ পূর্ব বাংলার জনগণ যুক্তফ্রন্টের পক্ষে সমর্থন প্রদান করে।
৯. মৌলিক অধিকার খর্ব : মুসলিম লীগ সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করে। বিভিন্ন পত্রিকা বন্ধ, বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আটকসহ নির্যাতন শুরু করে মুসলিম লীগ।
১০. আইনশৃঙ্খলার অবনতি : মুসলিম লীগ সুপরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। জনজীবন নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়, যা মুসলিম লীগের পতন ডেকে আনে।
১১. সংবিধান প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতা : মুসলিম লীগ রচিত সংবিধান ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। দীর্ঘ ৯ বছর পর সংবিধান রচনা করলেও তাতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোনো ভারসাম্য ছিল না। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ও সংবিধান স্থগিত হয়ে যায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম লীগ সরকার অগণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দমনপীড়ন চালাতে
থাকে। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ক্রমাগত শ্রমিক ধর্মঘট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি। কৃষকবিদ্রোহ, পুলিশ বিদ্রোহ, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ভাষাগত সমস্যা প্রভৃতি। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ করে দেয়। ১৯৫৪ সালের মার্চ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে অন্যদিকে, মাত্র ৮টি আসন লাভ করে মুসলিম লীগ। পূর্ব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ফলেই মুসলিম লীগের পরাজয় ঘটে।