মুসলিম দর্শন কী? এটি কিভাবে ধর্মতত্ত্বের সাথে সম্পর্ক ও পার্থক্য নির্দেশ করে?

অথবা, মুসলিম দর্শন কী? মুসলিম দর্শন কিভাবে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত ও বৈসাদৃশ্যযুক্ত?
অথবা, মুসলিম দর্শন বলতে কী বুঝ? মুসলিম দর্শনের সাথে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন কাকে বলে? মুসলিম দর্শনের সাথে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি প্রকৃতিগতভাবে মানুষের চিন্তাশক্তি উদঘাটিত হওয়ায় ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে। মানব সমাজের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ও অবিচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সংগতি রেখে নব নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। সংস্কৃতি, সভ্যতা ও চিন্তনের ঐতিহাসিক ধারার আবর্তে পতিত মানুষ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। সুতরাং মানুষের অদম্য কৌতূহল মানুষকে অজানা অনেক বিষয়ের রহস্য উন্মোচনে সর্বদা উদ্দীপ্ত করছে।
মুসলিম দর্শন : মুসলিম দর্শন হলো মুসলমান জাতির চিন্তাধারার দর্শন, মুসলিম চিন্তাবিদ কর্তৃক জীবন ও জগতের সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নের দর্শন। মুসলিম চিন্তাবিদেরা সার্বজনীন জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর প্রদান করেছেন। জীবন ও জগতের সমস্যাবলি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তাই মুসলিম দর্শন নামে পরিচিত। মানব জাতির চিন্তার
ইতিহাসে মুসলিম চিন্তাবিদেরা এক গৌরবময় অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন। প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে মানবজাতির চিন্তাধারার মধ্যে অখণ্ড যোগসূত্র রক্ষা করেছেন। মানব জাতির চলমান জীবনের বিভিন্নমুখী ক্রমবর্ধমান জটিলতাই মানব চেতনাকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করে তুলেছে। সংকীর্ণ অর্থে কোন কোন চিন্তাবিদ মুসলিম দর্শন বলতে কেবল কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা ও সৃষ্টি,. জগৎ ও জীবন, জীব ও জীবাত্মা, হইলৌকিক ও পারলৌকিক, জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নকে বুঝিয়েছেন। ও আবার ব্যাপক অর্থে কোন কোন চিন্তাবিদ বলেছেন, মুসলিম দর্শন হচ্ছে মুসলিম চিন্তাবিদদের যেকোন দার্শনিক আলোচনা, হোক সেটা গ্রিক দর্শনভিত্তিক, কি কোরআন ও হাদিস ভিত্তিক অথবা সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজস্ব মতামতভিত্তিক।” সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, “মুসলিম দর্শন হলো কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা।” অর্থাৎ মুসলিম চিন্তাবিদগণ কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে জীবন জিজ্ঞাসার তথা জীবন ও জগতের যে
বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন তাই মুসলিম দর্শন।
মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব : মুসলিম ধর্মতত্ত্ব একটা প্রত্যাদেশ নির্ভর ধর্মতত্ত্ব। মুসলিম দর্শনের মতো মুসলিম ধর্মতত্ত্বও মূলত কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে বলে এদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। নিম্নে মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্বের সম্পর্ক আলোচনা করা হলো :
১. মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব উভয়ই চায় পরম সত্তা বা চরম সত্তাকে জানতে এবং মানুষের কল্যাণ বিশ্বজগতে প্রতিষ্ঠা করতে। উভয়রই প্রধান লক্ষ্য এক ও অভিন্ন, কেননা উভয়ই বিশ্বজগতের স্বরূপ, মানুষের স্থান, বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহর সাথে জগৎ ও মানুষের সম্পর্ক, জগৎ ও জীবনের সামগ্রিক
ধারণা ইত্যাদি জানতে চায়।
২. মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব পরস্পর আলাদা নয়। ইসলাম ধর্মই মুসলমান জাতিকে নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনী ধ্যান ধারণার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যুগে যুগে মুসলিম চিন্তাবিদের মধ্যে জীবন ও জগতের
সমস্যাবলি সমাধানে কুরআন ও হাদিসের নিয়মাবলি প্রয়োগ করা হয়েছে। সুতরাং মুসলিম দর্শন ইসলাম ধর্মকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
৩.মুসলিম জাতির চিন্তাধারার ইতিহাসে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দর্শনের স ৃষ্টি হয়নি, বরং ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি একসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। সুতরাং মুসলিম দর্শন একাধারে ধর্মভিত্তিক, জীবনধর্মী বাস্তব।
মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব উভয়েই উৎস কুরআন ও হাদিস। কুরআনের আলোকে গবেষণা ও শরীয়তের
৪.নিয়মকানুন প্রণয়ন, ফিকহ শাস্ত্রের উৎপত্তি ইত্যাদি প্রয়োগে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক সমস্যাদির সমাধানের প্রচেষ্টা উভয় তত্ত্বের আলোচ্যবিষয়।
৫. মুসলিম দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ উভয়ের এক মনিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে। স্রষ্টার এক পরম উদ্দেশ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সার্থকতা লাভ করেছে। উদ্দেশ্যহীন যান্ত্রিকতা বা অযৌক্তিকতা জড়ত্ব মুসলিম জাতির
চিন্তাধারাকে পঙ্গু করে নি। মুসলিম জাতির চিন্তাধারায় সৃষ্টিতত্ত্ব স্রষ্টার পরম উদ্দেশ্যের পোষকতা করেছে। সুতরাং এদিক থেকে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্বের পার্থক্য : মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। যথা :
১. মুসলিম দর্শনের প্রধান অবলম্বন হলো বুদ্ধি ও বিচারশীল চিন্তা। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের প্রধান অবলম্বল হলো বিশ্বাস ও ভক্তি।
২. মুসলিম দর্শন বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে মৌলিক সমস্যাবলির সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাস ও সত্তার মাধ্যমে তার আলোচ্য বিষয়াবলিকে জানতে চায় ।
৩. মুসলিম দর্শনের জ্ঞান স্পষ্ট, যুক্তি সঙ্গত, বিচারবাদী ও বোধগম্য। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান অস্পষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত নয়।
৪.মুসলিম দর্শন অভিব্যক্তিবাদে বিশ্বাসী। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টিবাদে বিশ্বাসী ।
৫. মুসলিম দর্শনের আলোচনায় যুক্তি বিজ্ঞানের উপর জোর দেয়া হয়। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় অনেক সময় রূপকের মাধ্যমে বর্ণনা দেয়া হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব উভয়ে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। উভয়ের লক্ষ্য সত্য। কিন্তু তারা ভিন্ন পথে এই সত্যের সন্ধান করে। ধর্মতত্ত্ব স্বজ্ঞা ও প্রত্যাদেশের সাহায্যে এবং দর্শন বিচার বুদ্ধির বলে একই পরমসত্তাকে খুঁজে থাকে। সুতরাং মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব উভয়ই কুরআন ও হাদিসের প্রেক্ষিতে
জীবনের সমস্যাবলি আলোচনা করে, জীবনের মূল্য নির্ধারণ করে।