অথবা, মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্বের সংজ্ঞা দাও। এদের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্বের মধ্যে বৈসাদৃশ্য বর্ণনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্বের পার্থক্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন মুসলিম ধর্মতত্ত্ব থেকে কিভাবে পৃথক তা আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : মুসলিম চিন্তাবিদরা জীবন ও জগতের সমস্যাবলি আলোচনা করে মানবজীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যের নির্দেশ দান করেছেন। জীবন জগতের সমস্যাসমূহের সামগ্রিক আলোচনায় তারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় তুলে ধরেছেন। মানবজাতির চলমান জীবনের বিভিন্নমুখী ক্রমবর্ধমান জটিলতাই মানবচেতনাকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, ব্যাপক
থেকে ব্যাপকতর করে তুলেছে। মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ধর্মীয় চেতনা যেমন তাদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে, মুসলিম জাতির জীবনেও ধর্মীয় চেতনা তেমনভাবে তাদের চিন্তাভাবনাকে নিবিড়ভাবে প্রভাবিত করে এক বলিষ্ঠ জীবনদর্শন গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
মুসলিম দর্শন : মুসলিম দর্শন হলো মুসলমান জাতির চিন্তাধারা। মুসলিম চিন্তাবিদগণ জীবন ও জগতের সমস্যাবলি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তাই ‘মুসলিম দর্শন’ বলে পরিচিত। মানবজাতির ইতিহাসে মুসলিম চিন্তাবিদগণ এক গৌরবময় অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন। তারা প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে মানবজাতির চিন্তাধারার মধ্যে অখণ্ড যোগসূত্র রক্ষা করেছেন। মুসলিম চিন্তাবিদগণ জীবন ও জগতের সমস্যাবলি আলোচনা করে মানবজীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যের নির্দেশ দান করেন। ড. আমিনুল ইসলাম মনে করেন, “মুসলিম দর্শন বলতে বুঝায় এমন এক মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনকে, যার উৎপত্তি কুরআন ও হাদিস থেকে এবং যা ক্রমবিকশিত হয়েছে পরবর্তীকালে আবির্ভূত বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসার ফলশ্রুতিতে।” (মুসলিম দর্শনের স্বরূপ ও পরিসর; পৃ: ৮)।
মুসলিম ধর্মতত্ত্ব : ধর্মতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Theology’. ধর্মতত্ত্ব হলো এমন বিদ্যা, যেখানে ধর্মের স্বরূপ, ধর্মীয় বিধিবিধান ও আচারঅনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কার্যাবলি, ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনার ভূমিকা ও উপযোগিতা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। অতিপ্রাকৃতিক সত্তা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধার্মিকতা, ধর্মীয় প্রভাব ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়ের
আলোচনা নিয়ে ধর্মতত্ত্ব গড়ে উঠে। ধর্মতত্ত্বের দুটি রূপ দেখা যায়। যথা : ক. প্রাকৃতিক এবং খ. প্রত্যাদিষ্ট।
ক. প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব : প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব বলতে বুঝায় এমন এক ধর্মতত্ত্বকে, যেখানে প্রত্যাদেশ ছাড়াই বুদ্ধি, যুক্তি, রীতিনীতি, জীবনযাপন প্রভৃতির মাধ্যমে ধর্মীয় বিশ্বাস বা মতের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়।
খ. প্রত্যাদিষ্ট ধর্মতত্ত্ব : প্রত্যাদিষ্ট ধর্মতত্ত্ব বলতে এমন ধর্মতত্ত্বকে বুঝায়, যেখানে ধর্মীয় মতের পক্ষে যুক্তির পরিবর্তে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেয়া যায়। এক্ষেত্রে ধর্মতত্ত্ব পরমসত্তা বা চরম সত্য এমন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ পরম সত্যকে উৎসগতভাবে জানা ও উপলব্ধি করা বুদ্ধির ব্যাপার নয়, বিশ্বাসের ব্যাপার। “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর” কথাটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। “পরমসত্তা আছেন এবং তিনিই একমাত্র সত্য” এ বক্তব্যটি যুক্তির মাধ্যমে কিছু অংশে বোধগম্য হলেও ঐশী সত্তার প্রকৃত স্বরূপ জানার পন্থা নিছক যুক্তি নয়, বরং প্রত্যাদেশ। এ ধরনের ধর্মতত্ত্ব সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।
মুসলিম দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য : মুসলিম দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মুসলিম ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি অহি (নফল), আর মুসলিম দর্শনের ভিত্তি হলো আকল,
নফল, কাশফ।
২. মুসলিম দর্শন ব্যতিক্রম ছাড়া যুক্তির অভ্রান্ত শক্তিতে আস্থা স্থাপন করে। কিন্তু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রেও যুক্তির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব প্রত্যাদেশ ও ইলহাম এর উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যাদেশ নবী ও
রাসূলদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর ইলহাম হলো সাধকের ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা। তাই মুসলিম ধর্মতত্ত্বে অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে মনে করা হয়।
৩. মুসলিম দর্শনের প্রধান অবলম্বন হলো বুদ্ধি ও বিচারশীল চিন্তা। পক্ষান্তরে, মুসলিম ধর্মতত্ত্বের প্রধান অবলম্বন হলো বিশ্বাস ও ভক্তি।
৪. মুসলিম দর্শনে পরমসত্তা ও চরম সত্যকে জানার পন্থা হলো বুদ্ধি ও বিচারশীল চিন্তা। পক্ষান্তরে, মুসলিম ধর্মতত্ত্বে পরমসত্তা বা চরম সত্যকে জানার পন্থা হলো অবিচল বিশ্বাস।
৫. মুসলিম দর্শন বিচারবাদী। কেননা এর আলোচ্যবিষয়ের ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন যুক্তিচিন্তন বা বিচারবিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে। পক্ষান্তরে, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে বলে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের পদ্ধতি
ততটা বিচারবাদী নয়। অন্যকথায় প্রাধিকারবাদী।
৬. মুসলিম দর্শন দর্শনের মতো সত্তা বা পরমসত্তা বা জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যাসমূহ বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে আলোচনার প্রচেষ্টা চালায়। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ঐসব বিষয়াবলির জ্ঞান প্রত্যাদেশের মাধ্যমে পাওয়া যায় মনে করে এবং বিশ্বাসের উপর জোর দেয়।
৭. মুসলিম দর্শনের যুক্তির মাধ্যমে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা প্রদান করা হলেও মুসলিম ধর্মতত্ত্বে রূপকের মাধ্যমে বর্ণনা দেয়া হয়।
৮. মুসলিম ধর্মতত্ত্ব মূলত বিশ্বাস ও স্বজ্ঞার মাধমে তার আলোচ্যবিষয়াবলিকে জানতে চায় এবং পরিণামে এগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নেয়।
৯. মুসলিম দর্শন জ্ঞানের জন্য ৩টি উৎস যথাক্রমে আকল, নফল ও কাশফের কথা স্বীকার করে। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব কেবল নফলের উপর গুত্বারোপ করে।
১০. মুসলিম দর্শন ইসলামের ভাবগত ব্যাখ্যা প্রদান করে। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ইসলামকে শাশ্বিক দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করে।
১১. মুসলিম ধর্মতত্ত্বে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ কল্পনাও করা যায় না। অন্যদিকে, মুসলিম দর্শনে যেখানে ধর্মের সাথে যুক্তিবুদ্ধির কিংবা স্বজ্ঞার বিরোধ সেখান হতে বিচ্যুতি দেখা যায় ।
১২. মুসলিম দর্শনে অনেক সময় অনৈসলামিক বিষয়াবলি দেখা যায়। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মতত্ত্বে অনৈসলামিক বিষয়াবলি কল্পনাও করা যায় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমান চিন্তাবিদদের জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা এবং সে সম্পর্কে তাদের মতামতই মুসলিম দর্শন হিসেবে পরিচিত। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে তুলনামূলক আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আর এ দিক দিয়ে অন্যান্য দর্শন যেমন- গ্রিক দর্শন, ভারতীয় দর্শনের সাথে মুসলিম দর্শন পাঠও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ । মুসলিম দর্শন ও মুসলিম ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট আলোচনার জন্য এদের পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। মূলত মুসলিম দর্শন যুক্তিনির্ভর আর মুসলিম ধর্মতত্ত্ব বিশ্বাসনির্ভর।