ভ্রমণক্লান্ত কবির নীড়াশ্রয়ী মন কিভাবে শান্তি পেল ‘বনলতা সেন’ কবিতা অবলম্বনে বর্ণনা কর।

অথবা, ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবির প্রেমানুভূতির স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, “ববনলতানলতা সেন’ কবিতা নারীর চিরায়ত সৌন্দর্য মাধুর্যের মহিমা গান”-
নির্ণয় কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : বনলতা সেন’ রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) এ কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। ভ্রমণক্লান্ত কবির নীড়াশ্রয়ী মন তাঁর কাঙ্ক্ষিত নীড়ের সন্ধান পেয়েছে। হাজার বছর ধরে পথ চলার ক্লান্তির নিরসন হয়েছে এক প্রেমময়ী নারীর সান্নিধ্যের মধ্য দিয়ে। পুরুষের চিরন্তন প্রেমাকাঙ্ক্ষা নারীর কোমল হৃদয়ের সংস্পর্শে সার্থকতা লাভ করেছে।
ভ্ৰমণকান্ত কৰি মন : ‘বনলতা সেন’ কবিতায় হাজার বছরের পথযাত্রী কবি মূলত সন্ধান করেছেন একটি নিভৃত নীড়ের। নীড়কে আশ্রয় করেই তিনি বাঁচতে চেয়েছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রেয়সীকে নিয়ে। অনাদিকাল থেকেই পুরুষ তার দয়িতার সন্ধানে যুগ থেকে যুগান্তরে ভ্রমণ করে চলেছে। ক্লান্তির অবসাদে ছেয়ে গেছে তার প্রেমাকাঙ্ক্ষী মন। তবুও সে থেমে থাকেনি। কাঙ্ক্ষিতকে লাভ করার আশায় সে অবিরাম হেঁটে চলেছে। কবি এ প্রেমিক সত্তার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন এ কবিতায়। নীড়ের সন্ধানে তিনি সুদূর অতীত থেকে বর্তমানের নাটোর পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছেন। অবশেষে তাঁর ভ্রমণক্লান্ত মন খুঁজে পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত প্রেয়সীকে। কবির ভাষায়-


“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।


হালভাঙা দিশেহারা নাবিক যেমন সমুদ্রের বুকে সবুজ ঘাসে ভরা দারুচিনি দ্বীপ দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হয়; তেমনি ভ্রমণক্লান্ত কবির আত্মা নাটোর এসে বনলতা সেনকে দেখে তার কাঙ্ক্ষিত নীড়ের সন্ধান পান। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো যখন সন্ধ্যা নামে, পাখিরা যখন ঘরে ফিরে আসে, জীবনের সব লেনদেন যখন ফুরিয়ে আসে তখন ক্লান্ত কবিমন সন্ধ্যার অন্ধকারে বনলতা সেনের মুখোমুখি হয়ে শান্তি খুঁজে পায়।
প্রেম ও প্রকৃতি : প্রেম ও প্রকৃতি ‘বনলতা সেন’ কবিতায় পরস্পরের পরিপূরক। প্রেমের শাশ্বত অনুভূতির স্পন্দনে কবিতাটি সমৃদ্ধ। সেই প্রেমানুভূতির সাথে চমৎকারভাবে মিশে আছে কবির প্রকৃতি চেতনা। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য ব্যতীত প্রেম কখনো পূর্ণতা পায় না। প্রেমকে চিরকালই প্রকৃতির হাত ধরে চলতে হয় পথ। হাজার বছর ধরে প্রেম ও প্রকৃতি এভাবে পাশাপাশি পথ চলছে। কবি প্রেমকে পরিপূর্ণ করার লক্ষ্যে ইতিহাস ও ভূগোলাশ্রয়ী প্রকৃতি এবং নিসর্গকে টেনে এনেছেন ‘বনলতা সেন’ কবিতায়। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে ভৌগোলিক সীমানার নির্দেশনার প্রেম আবর্তিত হয়েছে প্রকৃতির হাত ধরে। প্রেমের বিচরণ দেখে নিসর্গ খুলে দিয়েছে তার অমৃত ভাণ্ডার। বিম্বিসা, অশোক, সমুদ্র, প্রাচীন নগরী, নাটোর প্রভৃতির পাশাপাশি সবুজ গাস, দারুচিনি দ্বীপ, পাখির নীড়, শিশিরের শব্দ, ডানার রৌদ্র, আকাশের চিল, সন্ধ্যা, জোনাকির ঝিলমিল, ঘর ফেরা পাখি, বহমান নদী এবং সন্ধ্যার অন্ধকার প্রেমকে পূর্ণতা দান করেছে। এ সকল প্রাকৃতিক উপকরণের সমন্বয়ে প্রেম হয়ে উঠেছে শাশ্বত। কবির ভাষায়,


“সব পাখী ঘরে আসে-সব নদী ফুরায়- এ জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”


নীড়াশ্রয়ী প্রেমিক সত্তা : প্রেমের আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে মানুষ সংসার ছাড়ে, অনিশ্চিত পথের যাত্রী হয়ে উৎসর্গ করে জীবনকে। প্রত্যেক প্রেমিক পুরুষ তার ক্লান্তির অবসান ঘটাতে চায় প্রেমিকার বাহুবন্ধনের আশ্রয়ে। মানুষ তার সারা দিনের সারা জীবনের ক্লান্তি দূর করে কাঙ্ক্ষিত নারীর সান্নিধ্যে আসতে চায়। পুরুষের জীবন সমুদ্র সহস্র তরঙ্গের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সফেন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে একটুখানি নীড়ের আশ্রয় আর নিবিড় শান্তি তার একান্ত কাম্য হয়ে উঠে। এ প্রেমিক সত্তা চির অজর অমর। কাল থেকে কালান্তর, যুগ থেকে যুগান্তরে এ সত্তা সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় পুরুষের এ প্রেমিক সত্তা তার কাঙ্ক্ষিত প্রেমময়ীকে খুঁজে পেয়েছে হাজার বছর পথ চলার পর। পুরুষের এই প্রেম চিরন্তন। অনির্বাণ শিখার মতো তা প্রেমিকের হৃদয়কে সর্বদা আলোকিত করে রাখে।
কবির প্রেমানুভূতি : ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের যে প্রেমানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তা কেবল একজন মানুষের ব্যক্তি অনুভূতি নয়। কবির অনুভূতি এই কবিতায় সমগ্র পুরুষ জাতির প্রেমানুভূতিকে ব্যক্ত করে তুলেছে। শ্রমক্লান্ত পুরুষ চিরকাল শান্তির অন্বেষণ করে চলেছে। এ শাস্তির জন্য সে অনেক সময় ধরে অনেক পথ অতিক্রম করে ফিরছে। কিন্তু কোথাও সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তিকে সে করতলগত করতে পারেনি। মানুষের প্রেমিক মন শাস্তি পেতে পারে কেবল শাশ্বত নারী সত্তার সংস্পর্শে। এ কবিতায় কবির প্রেমিক মন শেষ পর্যন্ত বনলতা সেনের সান্নিধ্যে এসে শান্তির সন্ধান পেয়েছে। কবি তাই নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন


“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি;

বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে,
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”


বাস্তবে বনলতা সেনের কাছে ক্লান্ত শ্রান্ত কবি দু’দত্তের শাস্তি পেয়েছিলেন তাঁর পাখির নীড়ের মতো চোখের আশ্রয়ে। এ দু’দণ্ড শান্তি হচ্ছে ক্ষণিকতার চকিত উদ্ভাস। আসলে ক্ষণিকতাই হচ্ছে প্রেমের ধর্ম। কিন্তু সেই দু’দণ্ডের উষ্ণ অনুভব ও প্রশান্তি স্মৃতি ও স্বপ্নের জগতে কালের পরিধি অতিক্রম করে মানবের শাশ্বত অনুভব রূপে আত্মপ্রকাশ করল। এ প্রতিবিকাশে বনলতা সেন রূপান্ত রিত হলো প্রেমের চির উজ্জ্বল প্রতীকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবির নীড়াশ্রয়ী মন অধ্যবসায়ের কঠিন পরীক্ষায় প্রেমিকার সংস্পর্শে শান্তির সন্ধান পেয়েছে। কবিতাটিতে কবি প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে একে একটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a7%8d/