ব্র্যাক কি? ব্র্যাক পরিচালিত কার্যক্রমের বিবরণ দাও।

উত্তর ঃ ভূমিকা ঃ ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি বিলিফ অর্গানাইজেশন হিসেবে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়। এর উদ্যোক্তা হলেন জনাব ফজলে হাসান আবেদ। শুরুতে এর নাম ছিল “Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee” পরবর্তীতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি
উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে তিনি এ সংস্থাটিকে “Bangladesh Rural Advancement Committee” বা সংক্ষেপে BRAC নাম দেন।
→ ব্র্যাক ঃ বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিক্ষার প্রসার, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জড়িত সর্ববৃহৎ বেসরকারি সংস্থা হলো ব্র্যাক (BRAC)। ২০০২ সাল থেকে ব্র্যাক দেশের বাইরে আফগানিস্তানে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করেছে। বর্তমানে ব্র্যাক দেশের ৬৪টি জেলার ৪৮০টি উপজেলার ১১০১১৯ জন নিয়মিত কর্মী ও ৫৩৩৭৯ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক
নিয়ে ৭.৩৭ মিলিয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
→ ব্র্যাকের সংস্থা কার্যক্রম ঃ বাংলাদেশে দুঃস্থ-দরিদ্র অসহায় জনগণের কল্যাণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাক বহুমুখী কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। নিম্নে এর কর্মসূচিগুলো দেওয়া হলো ঃ
১. আর. ডি. পি (Rural Development Program -RDP) আর. ডি. পি. বা পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় মূলত গ্রামের ভূমিহীন এবং পশ্চাপদ শ্রেণীর মানুষকে ভিলেজ অর্গানাইজেশন বা গ্রাম সংগঠনে সংগঠিত করা হয়। বাংলাদেশের ৫২ হাজার ৩৩টি গ্রামের আর.ডি.পি. ৭৪ হাজার ৪শ ২৮টি গ্রামে সংগঠিত করেছে। একটি পরিবার থেকে মাত্র ১ জনকেই গ্রাম সংগঠনের সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়। এ হিসেবে বাংলাদেশে ২৮ লাখ পরিবার ব্র্যাকের রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মধ্যে রয়েছে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, রেশম চাষ, মাছ চাষ, বৃক্ষরোপণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায় যেমন মুদির দোকান, রিকশা, ভ্যান, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। আর.ডি.পি. প্রোগ্রামের আওতায় যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তা হলো ঃ
(ক) আর. ডি. পি প্রোগ্রামের আওতায় গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষ বিশেষ করে নারী শ্রেণিকে গ্রাম সংগঠনে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। ব্র্যাক পরিচালিত প্রায় ৭৪ হাজার ৪শ, ২৮টি গ্রাম সংগঠনে ২৮ লাখ দরিদ্র মানুষ সংগঠিত হয়েছে এবং এদের ৯৬ শতাংশই হচ্ছে মহিলা।
(খ) আর. ডি. পি প্রোগ্রামের আওতায় ৩ হাজার ২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ ঋণগ্রহীতাদের ৯৪% মহিলা। বর্তমানে মাসিক ঋণ বিতরণের হার প্রতি মাসে ৮৮ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতাকে ১৫% সার্বিজ চার্জ প্রদান করতে হয়। এ ঋণের আওতায় মহিলা মালিকানাধীন মুদির দোকানের সংখ্যা ৩৯৫৬টি এবং রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৮৪৩টি।
(গ) আর. ডি. পি এর অধীনে ইনকাম জেনারেল ফর ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হয়। এটি ব্র্যাক ও সরকারের একটি যৌথ উদ্যোগ। এ প্রোগ্রামের লক্ষ্য হলো দরিদ্র মহিলা, যাদের জমি নেই, যারা বিভিন্নভাবে সমাজে
অবহেলিত, স্বামী পরিত্যক্ত তাদেরকে বিভি! উন্নয়ন ও আয় সংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করানো।
(ঘ) আর. ডি. পি’র অন্যান্য ইন্টারনেশন প্রোগ্রামের মধ্যে পোল্টি প্রোগ্রাম, ফিশারি, সামাজিক বনায়ন হিউম্যান রাইউস অ্যান্ড লিগ্যাল এডুকেশন প্রোগ্রাম ইত্যাদি রয়েছে।
২. এনএফপিই (Non – Formal Primary Education – NFPE) : ব্র্যাক ১৯৮৫ সালে মাত্র ২২টি স্কুল নিয়ে এনএফপিই প্রোগ্রাম চালু করে। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলায় এই প্রোগ্রাম সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব স্কুলে ৪ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। এখান থেকে প্রাইমারি শিক্ষাপ্রাপ্তদের ৮৫ ভাগ পরবর্তীতে ফরমাল স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি
হয়। ব্র্যাকের স্কুলে ৮ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাধারণ প্রাথমিক শিক্ষা এবং ১১ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের বেসিক এডু কেশন প্রদান করা হয়। ব্র্যাকের এসব স্কুলে থেকে ড্রপ-আউটের হার শতকরা ৫ ভাগেরও কম।
৩. এইচপিপি ঃ ব্র্যাক ১৯৭২ সালে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এইচপিপি বা হেলথ অ্যান্ড পপুলেশন প্রোগ্রাম শুরু করে। বর্তমানে তা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে প্রজনন স্বাস্থ্য, রোগ নিয়ন্ত্রণ, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, টিবি নিয়ন্ত্রণ চিকিৎসা পুষ্টি প্রোগ্রাম ইত্যাদি। এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৪০টি হেলথ সেন্টার ও ১২৫৩৬টি কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। সাড়ে তিন কোটি মানুষ ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে। এই প্রোগ্রামের আওতায় ৯৭ লাখ মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। ব্র্যাক দি বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রেশন প্রোগ্রাম (বি আই পি) এ ২৭ লাখ মানুষের পুষ্টি সেবা প্রদান করেছে। ব্র্যাক এসেনশিয়াল হেলথ কেয়ার (ই এইচ সি) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। এ প্রোগ্রামের আওতায় প্রায় ২ কোটি মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যসচেতনতা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, দূষণমুক্ত পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষা ইম্যুনাইজেশন সহায়তা পেয়ে থাকে।
৪. বিশাল কর্মযজ্ঞের সহায়তায় সাপোর্ট প্রোগ্রাম ঃ ব্র্যাকের বিশাল কর্মযজ্ঞে সহায়তা করার জন্য এর সাপোর্ট প্রোগ্রামের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। রাজেন্দ্রপুরের ব্র্যাক সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্টসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্র্যাকের ১২টি ট্রেনিঃ অ্যান্ড বিসোর্স সেন্টার এর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। এসব কেন্দ্রে উন্নয়ন কর্মীদের শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা, ডেজার, স্বাস্থ্য ইত্যাদি উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
পাবলিক অ্যাকেয়ার অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট ব্র্যাকের বিশাল কর্মকাণ্ড বিষয়ে দেশে বিদেশে স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টির কর্মসূচি পরিচালনা করে। এজন্য তারা ফিল্ড ভিজিট করে। গড়ে প্রতিমাসে ৮টি দেশি বিদেশি ডিডিগেশন গ্রুপকে ব্র্যাকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে এ বিভাগ সহযোগিতা করে থাকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিভাগ তথ্য সরবরাহ করে ব্র্যাকের কার্যক্রম জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরে।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ব্র্যাকের কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো দেশের দরিদ্রতা বিমোচন করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করা।