অথবা, ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্করাচার্য-এর মত কী?
অথবা, শঙ্করের ব্রহ্ম সম্পর্কীত অভিমত সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।ন
অথবা, শঙ্করের ব্রহ্ম তত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মহর্ষি বাদরায়ন (আনু. ৫০০ খ্রি. পূ.) প্রণীত বেদান্তসূত্রে (৫৫৫টি সূত্র) ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে বলে একে ব্রহ্মসূত্র বলে। আবার জীবের স্বরূপ বর্ণিত হওয়ায় একে শারীরিকসূত্রও বলা হয়। ব্রহ্মসূত্রের সাতটি ভাষ্যের (শঙ্করের শঙ্কভাষ্য, রামানুজের শ্রীভাষ্য, বল্লভের অনুভাষ্য, মাধ্বের পূর্ণপ্রজ্ঞাভাষ্য, নিম্বার্কের বেদান্তমপারিজাতসৌরভ, ভাস্করের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য এবং বলদেবের গোবিন্দভাষ্য) মধ্যে শঙ্করের শঙ্করভাষ্য এবং রামানুজের শ্রীভাষ্য অন্যতম। শঙ্করাচার্য ও রামানুজ উভয়ে বাদরায়নকে অনুসরণ করে অদ্বৈতবাদ প্রচার করলেও শঙ্কারাচার্যের অদ্বৈতবাদ কেবলাদ্বৈতবাদ এবং রামানুজের অদ্বৈতবাদ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত।
ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্করের মত : শঙ্করের মতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্ম স্বরূপ। শঙ্কর ব্রহ্মের সত্তা ছাড়া আর কোন কিছু স্বীকার করেন নি। সেকারণে শঙ্করকে ‘কেবলাঅদ্বৈতবাদী’ বলা হয়। ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে শঙ্কর বলেন, ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ ও মুক্ত। ব্রহ্ম অসীম অনন্ত ও নির্গুণ। তাঁর মতে, আত্মাই ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ও আত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শঙ্কর বলেন, ব্রহ্ম সৎ চিৎ ও আনন্দ স্বরূপ। ব্রহ্ম সৎ অর্থ তিনি অসৎ নয়। ব্রহ্ম চিৎ অর্থ তিনি জড় নয় এবং ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ অর্থ তিনি দুঃখ স্বরূপ নয়। ব্রহ্ম নির্বিশেষ অর্থাৎ তার কোন বিশেষ নেই। তাই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে হলে তিনি এ নয়, তিনি ঐ নয় ইত্যাদির সাহায্যে উপলব্ধি করতে হবে। শঙ্করের মতে, দুই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি হতে ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায়। যথা : ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো অজ্ঞানতা প্রসূত। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে জগত সত্য এবং ব্রহ্ম এ জগতের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও সংহারকর্তা। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্ম নানাবিধ গুণে সমন্বিত। তিনি সর্বত, সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান পুরুষ। এ
গুণবান ব্রহ্মকেই শঙ্কর সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ঈশ্বরেরই পূজা অর্চনা হয়। অন্যদিকে, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো জ্ঞান প্রসূত। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্ম জগতের স্রষ্টা, রক্ষক বা সংহার কিছুই নয়। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। তার কোন প্রকার প্রকারভেদ নেই। অর্থাৎ ব্রহ্মের স্বজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত ভেদ নেই। পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্ম সত্য-জ্ঞানও অনন্ত। এটি ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ। শঙ্করের মতো পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্মকে পরব্রহ্ম বলা হয়। উপনিষদে ব্রহ্মের দুটি রূপের কথা বলা হয়েছে। যথা : পরব্রহ্ম ও অপরাব্রহ্ম। শঙ্করের পরব্রহ্ম হলো নির্জন আর অপরাব্রহ্ম হলো সগুণ ব্রহ্ম। উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্ম বিশ্বজগৎ ও বিশ্বাতীত। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শঙ্কর বলেন, যতক্ষণ জগৎ প্রপঞ্চ বিদ্যমান
থাকে ততক্ষণ জগৎ ব্রহ্মেই অধিষ্ঠিত থাকে এবং ব্রহ্মও বিশ্বজগৎ হন। যেমন- ভ্রমাত্মক জ্ঞানবশত মিথ্যা সর্প রজ্জুতে অধিষ্ঠিত থাকে এবং রজ্জু ও সর্পকে অভিন্ন মনে হয়। সর্প যেমন রজ্জুকে কলুষিত করতে পারে না তেমনি জগত প্রপঞ্চও ব্রহ্মকে কোন রকমে কলুষিত করতে পারে না। আলোর সাক্ষাতে রজ্জু হতে মিথ্যা সর্প যেমন বিলুপ্ত হয় এবং রজ্জু স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। তেমনি বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট জগত প্রপঞ্চ বিদ্যমান থাকে না এবং ব্রহ্ম স্বরূপে অধিষ্ঠিত হন। সুতরাং বিজ্ঞ ব্যক্তিদের চিন্তায় ব্রহ্ম বিশ্বাতীত। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম সগুণ হলেও পারমার্থিক দৃষ্টিতে তিনি নির্গুণ। শঙ্
করের মতে পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের উপাসনার উপকারিতা শঙ্কর অস্বীকার করেন নি। তাঁর মতে, ঈশ্বরের উপাসনার দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং চিত্ত শুদ্ধ ব্যতিরেকে নির্গুণ ব্রহ্মের কোন ধারণাই হয় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে শঙ্কর ও রামানুজের মতের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। তবে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল আছে। আর তা হলো তারা উভয়ই ব্রহ্মকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন । ব্রহ্মের উপাসনাকেই জীবের মুক্তির উপায় বলে বর্ণনা করেছেন।