ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষার ভূমিকা আলোচনা কর।

ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষার ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষার যে ভূমিকা রয়েছে তা বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিকীকরণের শিক্ষার ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষা কী ভূমিকা পালন করে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রত্যেক জিনিসেরই একটা ধর্ম আছে। যেমন আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে ফেলা তেমনি মানুষেরও ধর্ম আছে। মানুষকে তার ব্যক্তিত্ব গঠনে যে ধর্মটি বিশেষভাবে কাজ করে তা হলো শিক্ষা। ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষা
এমন একটি মৌল প্রক্রিয়া যা মানব আচরণ ও তার ব্যক্তিত্বকে পরিবেশের সঙ্গে সংগতি বিধানের সর্বদা সহায়তা দান করে। সামগ্রিকভাবে পরিবার সামাজিকীকরণে খুব গুরুত্বর্ণ ভূমিকা পালন করে। তেমনি ব্যক্তির সামাজিকীকরণের শিক্ষারও ভূমিকা অপরিসীম।
শিক্ষার সংজ্ঞা : শিক্ষা একটি আজীবন মৌল প্রক্রিয়া (Key process)। যা মানব আচরণ ও তার ব্যক্তিত্বকে পরিবেশের সাথে সংগতি বিধানে সর্বদা সহায়তা দান করে। শিক্ষা বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যার সাহায্যে
আমরা ব্যবহার আচরণে একটা আপেক্ষিক স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারি। শিক্ষা বলতে আমরা তাকেই বুঝি যা নতুনয়কিছু আয়ত্তকরণ, পরিবেশ পরস্থিতি অনুযায়ী যথাযথ প্রতিক্রিয়া করা, আচরণ স্থায়ীকরণ, উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার
মধ্যে নবতর সম্পর্ক স্থাপন, আচরণে গতিশীলতা আনয়ন এবং ভ্রান্তি কাটিয়ে গঠিত পন্থার আচরণকে চালিত করা প্রভৃতিকে বুঝায় ।প্রকাশনী
ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষা : একটি মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর শিশুর বিদ্যার্জন, প্রেষণা, তাড়না
আগ্রহ, বাহ্যিক প্রয়োজন, অভাববোধ প্রভৃতি শিক্ষা দান করে তার পরিবার। এভাবেই শিশু থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে পৌঁছাতে
এবং সমাজের সাথে সামাজিকীকরণের জন্য পরিবার প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। তবে পরোক্ষভাবে শিক্ষা একজন ব্যক্তির
সামাজিকীকরণে তত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হলো :
১. ব্যক্তিকে যোগ্য সামাজিক জীব হিসেবে তৈরিতে শিক্ষা : আমরা প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু শিখি। মানব শিশু ভূমিষ্ট
হবার পর থেকে গৃহ, বিদ্যালয়, গোষ্ঠী জীবন ইত্যাদিতে নতুন নতুন পরিবেশ পরস্থিতির সম্মুখীন হয় এবং যেসবকে শিক্ষার
মধ্য দিয়েই আয়ত্তে এনে সামাজিকভাবে খাপখাইয়ে নিতে শেখে। এ খাপখাইয়ে বা সামাজিকীকরণে ও সংগতি বিধান করে
এসব পরিবেশের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি প্রতিনিয়ত আচরণগত পরিবর্তন আনয়ন করে শিক্ষার মাধ্যমে। সামাগ্রিক পরিমণ্ডলে
একজন উপযুক্ত ও যোগ্য সামাজিক জীব হিসেবে সমাজ জীবনযাত্রার প্রয়োজনে ব্যক্তিকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক।
যা তার সমাজের অন্যান্য সামাজিক জীব ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সামাজিকীকরণে শিক্ষা ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
২. ব্যতির রাজনৈতিক জীবনে শিক্ষা : ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। প্রতিটি সমাজে প্রতিটি ব্যক্তি রাজনৈতিক জীব। একটি সমাজের অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এবং শোষণ, শাসনের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদের সুর দৃঢ়তার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন। আর এ রাজনীতি পরিচালনা করে ব্যক্তি। আর ব্যক্তিকে সামাজিকীকরণে অর্জিত শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণে সমাজের শাসক শ্রেণি ব্যর্থ হলে
সমাজ তার গতিশীলতা হারায় এসময় ব্যক্তি তার রাজনৈতিক জ্ঞান দ্বারা সমস্যার সমাধান করেছেন যা ব্যক্তি শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে। এজন্য বলা যায়, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. ব্যক্তির সামাজিকীকরণে ধর্মীয় শিক্ষা : ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের দিকনির্দেশনা দেবার বিধানই হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষার অনুশাসন মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যে ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারী হোক না কেন তাকে অবশ্যই তার নিজের ধর্মের আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে হয়। শৈশবকাল হতে যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ব্যক্তি সেই ধর্মীয় মূল্যবোধ যারা লালিত হয় এবং পরবর্তীকালে এগুলো তার জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। ধর্ম সমাজের নিয়ন্ত্রণের একটা উৎকৃষ্টতম মাধ্যম। আর ব্যক্তি এ ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও অসামাজিক, অবৈধ কার্যকলাপ হতে সমাজকে রক্ষা করে। ব্যক্তি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হলে মহৎ গুণাবলি এবং সমাজে সম্মানী গুণীজনে পরিণত হয় এবং বিভিন্নভাবে সমাজ তথা সমগ্র দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গতিশীলতা দান করতে পারে। এ
থেকেই বুঝা যায় যে, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে ধর্মীয় শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর অবদান অপরিসীম।
৪. ব্যতির স্বদেশ প্রেমে শিক্ষার ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব এবং ব্যক্তি সমাজ আদি থেকেই সমাজে সংবদ্ধভাবে বসবাস করে আসছে। সমাজ রক্ষার্থে, সমাজের শাক্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে তথা দেশের সার্বভৌম রক্ষার্থে ব্যক্তির স্বদেশ প্রেম থাকা বাঞ্ছনীয়। আর ব্যক্তি এ স্বদেশ প্রেমের ধারণা লাভ করে শিক্ষার মাধ্যমে যা ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ফল। ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, শিক্ষা ব্যক্তিকে একজন স্বদেশপ্রেমী হিসেবে গড়ে তোলে।
৫. ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার ভূমিকা : দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একথা অস্বীকার করা যাবে না। একটা জাতির মেরুদণ্ডই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানুষ তৈরির উত্তম
কারখানা। পরিবারের মধ্যদিয়ে শিশুর যে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা বিস্তার লাভ করে।
অনেক সময় দেখা যায় ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষকদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সবসময় তাদেরকে অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করে। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণে শিক্ষাদান করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যাবতীয় মানবীয় আচার-আচরণ এককথায় স্বকীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের জ্ঞান দান করে যারা পরবর্তীতে দেশ রক্ষার এবং পরিচালনার ভার সুদৃঢ়
হস্তে গ্রহণ করে। এভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানব শিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবারই তাকে একটি সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সুষ্ঠু সামাজিকীকরণে একজন আদর্শ, সৎ, নির্ভীক, সাহসী ও সুনাগরিক গড়ে তোলে। তবে ঐক্তিকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে যে শিক্ষার আলো তার আচরণে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং সমাজ তথা দেশের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তবে একজন ব্যক্তির প্রকৃত সামাজিকীকরণের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে যক্তি তার ব্যক্তিত্বের চরম উৎকর্ষ সাধন করে। এজন্য নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায় যে, ব্যক্তির প্রকৃত সামাজিকীকরণ
একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব; অন্যথা নয়।