বিচ্যুতির কারণসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, কী কী কারণে জীবনে বিচ্যুতি ঘটে? বর্ণনা কর।
অথবা, বিচ্যুতি কেন ঘটে? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
Deviance এর ধারণাটি এসেছে Statistics থেকে, যার অর্থ হলো বিচ্যুতি। সাধারণভাবে বলা যায়, সামাজিক মূল্যবোধ বা নিয়মের লঙ্ঘনই হলো Deviance বা বিচ্যুতি। সামাজিক মূল্যবোধকে মুখ্য বা প্রধান (dominant) এবং গৌণ বা পরিবর্তনশীল এ দুশ্রেণীতে ভাগ করা যায়। গৌণ মূল্যবোধ ও তৎসম্পর্কিত রীতিনীতিসমূহ
কেউ পালন করে আবার কেউ করে না। যার কারণে মানুষের আচার আচরণের বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। Deviance এর ধারণাটি ব্যাপক। Deviance এর বিমূর্ত সংজ্ঞা দেয়া বেশ কষ্টকর। কেননা সমাজে এমনকিছু নিয়ম কিংবা রীতিনীতি প্রচলিত আছে যা লঙ্ঘন করা সমাজের জন্য কল্যাণের।
বিচ্যুতির কারণসমূহ : P. B. Horton এবং C. L. Hunt তাঁদের ‘Sociology’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “The term social deviance is given to only failure to conform to the customary norms of the society.” অর্থাৎ সমাজের অস্বীকৃত কার্যকলাপকেই বলা হয় Deviance behaviour বা বিচ্যুত ব্যবহার।
Deviance এর কারণকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায় নিম্নোক্তভাবে :
ক. জৈবিক কারণ (Biological cause),
মানসিক কারণ (Psychological cause),
গ. সামাজিক কারণ (Social cause)।
প্রত্যেক মানুষের বিচ্যুতিমূলক আচরণের পিছনে এ ধরনের কারণগুলো দায়ী। পারিবারিক অভাব অনটন, অনাধিক্য পরিবার, অপরাধ পরিবার ইত্যাদি ছাড়াও বিচ্যুতিমূলক আচরণের পিছনে রয়েছে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া। নিম্নে বিচ্যুতিমূলক ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য কারণগুলো তুলে ধরা হলো :
১. অপরাধপ্রবণ সামাজিক পরিবেশ : ব্যক্তিমানুষের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতি অমান্য করার কারণ হিসেবে অপরাধপ্রবণ প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশের কথা অনেকেই বলে থাকেন। সমাজ বিরোধী ব্যক্তিবর্গের অনেক ছেলেমেয়ে সমাজ বিরোধী পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং সে পরিবেশে লালিতপালিত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে দুষ্ক্রিয়তা দেখা দেয়। এসব শিশুরা বিভিন্ন প্রকার অপরাধের পন্থা, প্রকৃতি প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে শিখে থাকে। ফলে তারাও পরিবর্তীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে খুব সহজে জড়িয়ে পড়ে।
২. অপসংস্কৃতির প্রভাব : সাম্প্রতিক সময়ে শহরে এমনকি গ্রামে বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল, সিডি, ভিসিডি, মোবাইল ফোনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এগুলো দেখে লোকজন ঐসব পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ পুরাতনের জায়গায় নতুন সংস্কৃতি প্রতিস্থাপিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের Norms এবং Value এগুলোকে ভালো মনে করে না। আর তাই দিনদিন বিচ্যুতিমূলক ব্যবহার বা Deviance বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রভাব : সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজের মানুষকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করে। সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রেক্ষিতে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের অবস্থান ও মর্যাদা বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। উচ্চশ্রেণীর লোকেরা নিম্নশ্রেণীর লোকের চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। ফলে স্বভাবতই নিম্নশ্রেণীর লোকদের মধ্যে বিচ্যুতিমূলক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি।
৪. কুসংস্কার ও রূপকথায় বিশ্বাস : কুসংস্কার ও রূপকথায় বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিচ্যুতিমূলক ব্যবহার সৃষ্টি হতে পারে। প্রায়ই পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে মা তার সন্তানকে হত্যা করেছে। বিশেষত আদিবাসী সমাজে সন্তান হত্যার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।
৫. ব্যক্তিগত বিষয় : অনেক সময় ব্যক্তিগত বিষয়ও বিচ্যুত ব্যবহারের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কোন নির্যাতনের ঘটনা বা অমানবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তি মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় আবার বিশেষ কোন ঘটনার স্মৃতি ব্যক্তিমানুষের মানসিক ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। ফলে বিচ্যুতিমূলক ব্যবহার বৃদ্ধি পায়
৬. সামাজিক পরিবর্তনের প্ রভাব : বর্তমান সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। ফলে ব্যক্তিমানুষের জীবনধারায় বিভিন্ন ধরনের পরস্পরবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ অবস্থায় মানুষ বিচ্যুতিমূলক ব্যবহারে লিপ্ত হয়ে পড়ে নিজেকে অন্যের মতের সাথে মানিয়ে না নেয়ার কারণে।
৭. ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার প্রভাব : বর্তমান আত্মকেন্দ্রিক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। নিজের উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে অপর্যাপ্ত অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে মানুষ তখন ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে নিজেকে অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত করে। আর তাই বিস্মৃতিমূলক আচরণ বৃদ্ধি পায়।
৮. সামাজিক নিয়মনীতি পালনে মানসিক অসামর্থ্য : বিচ্যুতিমূলক ব্যবহারের কারণ হিসেবে শারীরিক কিংবা মানসিক সামর্থ্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যে ব্যক্তি দৈহিক কিংবা মানসিকভাবে অসুস্থ তার পক্ষে যথাযথ অবস্থা অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গতভাবে আচরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিচ্যুতি ব্যবহারের সৃষ্টি হয়।
৯. প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাব : পরিবেশ ব্যক্তিকে সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে থাকে। প্রতিকূল পরিবেশে· বিচ্যুতির পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্য পরিবারের শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হয় বেশি। ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে। সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের সুষ্ঠু বিকাশে বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। আর বৃদ্ধি পায় বিচ্যুতি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিচ্যুতি ব্যবহারমাত্রই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না, বিচ্যুতি ব্যবহার অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় প্রভাবই সমাজে লক্ষ্য করা যায়। বিচ্যুতি ব্যবহারের কারণে সমাজের বিধিনিষেধ কার্যকরীকরণে বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। আবার বিচ্যুতি ব্যবহারের কারণে সমাজের পরিবর্তনও ঘটে থাকে। তারপরও বলা যায়, বিচ্যুতিমূলক ব্যবহারের কারণে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং সমাজে নিরাপত্তার অভাববোধও দেখা দেয়।