বাঙালি সংস্কৃতির উৎসসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালি সংস্কৃতির উৎসগুলো লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের জীবনযাত্রার প্রণালিই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠে। হাজারো বছরের মূল্যবোধ আচার-আচরণের বিশ্বাসের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মানবজীবনকে সুন্দর ও সুচারুভাবে গড়ে তুলতে সংস্কৃতি আবশ্যক। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সমাজ পর্যন্ত সভ্যতার বিকাশে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে । দৈনন্দিন জীবনযাপনে সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
বাঙালি সংস্কৃতি : সাধারণত বাঙালি সংস্কৃতি বলতে বাংলা ভাষাভাষী লোকদের মনোভাব, ভাবধারা, সাহিত্য- শিল্পকলার সংমিশ্রণকে বুঝায়। চিরাচরিত বাংলার বিশ্বাস, মূল্যেবোধ, শিল্পকলা, নীতি, প্রথা, আচার আচরণ,
আদর্শ এবং লোকাচারের সমন্বয়ে বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। এসবের সমষ্টিগত রূপই হলো বাঙালি সংস্কৃতি।
বাঙালি সংস্কৃতির উৎস : বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে নিজস্বতা, বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর লোকদের মিশ্রণে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । নিচে এটি ব্যাখ্যা করা হলো :
১. ধর্মীয় উৎস : বাঙালি সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বঙ্গদেশের হিন্দু ধর্ম, বঙ্গীয় হিন্দু ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম, হিন্দু ধর্মের আচারঅনুষ্ঠান এবং লোকাচারে ধর্মীয় প্রভাব দেখা যায়। ধর্মীয় উৎসগুলো স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত দেবদেবীতে রয়েছে পার্থক্য। ইসলাম ধর্মও বঙ্গদেশে এসে বঙ্গীয় রূপ নিয়েছে। প্রথম দিকে সুন্নিদের তুলনায় সুফিবাদ বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। বাঙালিরা ইসলামের অনুসারী হলেও সংগীতকে যথেষ্ট লালন করেছেন। ফলে দেখা যায়, বিভিন্ন
গাছগাছালি যেমন— বট, অশ্বত্থ, তাল, তেতুল, পাখির মধ্যে কাক, শকুন, শালিক, নক্ষত্র, ভূত, প্রেত, জিন, পরি প্রভৃতিতে শুভ, অশুভ লক্ষণ । মানুষের জীবনাচরণে এদের উপযোগিতা আজও হারায়নি।
২. জীবন পদ্ধতি : বাঙালিদের জীবন পদ্ধতি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় উৎস। হিন্দুদের জীবনাচরণে ধান, দূর্বা, হলুদ, ধূপ, মাছ প্রভৃতির প্রভাব ওতপ্রোতভাবে রয়েছে। আবার বিবাহ, নৈতিকতা প্রভৃতিতে গোত্র প্রধান, সমাজপতিদের প্রাধান্য আজো প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়।
৩. ব্যবহৃত বস্তুসামগ্রী ও হাতিয়ার : বাঙালি সংস্কৃতির বড় উৎস হলো ব্যবহৃত বস্তুসামগ্রী ও হাতিয়ার। বাঙালিরা কৃষিকার্যে লাঙল, জোয়াল, ফাল, ঈশ, দা, দড়ি, মই ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে।গৃহস্থালির জন্য ঝুড়ি, চুপড়ি, ডিঙ্গি, হাঁড়ি, সরা, পাতিল এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজে ঝাঁটা, চাটি, বাখরি প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়।
৪. খাদ্যশস্য ও খাদ্যাভ্যাস : বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যশস্য বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎস। প্রবাদ আছে, মাছে ভাতে বাঙালি । বাঙালিরা খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসেন। বঙ্গদেশের সর্বত্র ধানের চাষ হয় এবং প্রধান খাদ্যশস্য ধান।এছাড়া মাছ, মিষ্টান্ন, পিঠে পুলি, সন্দেশের পরিবেশন দেখা যায়। কোনো কোনো অনুষ্ঠানের পর আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের খাদ্য বিশেষকরে মিষ্টি পাঠানোর রীতি রয়েছে। এছাড়া হিন্দু ও মুসলমানদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন ও বিধিনিষেধ পরিলক্ষিত হয়।
৫. পোশাক পরিচ্ছদ : বাঙালিদের পোশাক পরিচ্ছদ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎস। সাধারণত হিন্দুরা ধুতি পরত, বর্তমানে ধুতির পরিবর্তে লুঙ্গির ব্যবহার বেশি দেখা যায়। বাঙালি নারীরা সাধারণত শাড়ি পরেন। তবে বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে পাশ্চাত্যের পোশাক ও পরিচ্ছদ প্রায় মিশে গেছে।
৬. দৈনন্দিন হিসাবনিকাশ : হিসাবনিকাশ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায় বাঙালি সংস্কৃতিতে। কড়া, পণ, গণ্ডা, কুড়ি, কাহন গণনা পদ্ধতিগুলো অস্ট্রিক জাতি থেকে এসেছে। খামার, খড়, আড্ডা, লাড্ডু প্রভৃতি অস্ট্রিক সংস্কৃতির স্মারক । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দেওয়া যায় বিভিন্ন চিন্তা ও চেতনার বিকাশ
৭. বিদেশি আচার আচারণগত মূল্যবোধ : বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎস হলো বিদেশি আচার-আচরণ ও মূল্যবোধ। শিক্ষিত শ্রেণির ব্যক্তিরা অনেকক্ষেত্রে ইউরোপীয় আচার-আচরণ সামাজিক ও ঘরোয়া জীবন গ্রহণ করেছেন।পাকপ্রণালি ‘খাদ্যাভ্যাস’, ‘থালাবাসন’, ‘ঘরবাড়ি’ প্রভৃতি স্থাপনে বিদেশি মূল্যবোধ ও চেতনার বহিঃপ্রকশ দেখা যায় ।
পারলৌকিক কার্যাদি : বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎস হলো পারলৌকিক কার্যাদি। বাঙালি ঘরে কোনো নতুন শিশুর আগমন হলে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী তার আগমন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান করা হয় আবার কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী মৃত দেহের দাফন-কাফন সৎকার করা হয়। পাপ, পুণ্যের ওজন, স্বর্গ-নরকে অবস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে আচার আচরণ ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়, যা বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি সংস্কৃতি এটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। বিভিন্ন জাতি, মত, ধর্ম ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে সু অতীত ঐতিহ্য। তবে যেহেতু সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় ফলে বাঙালি সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।