অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল আলোচনা কর।
অথবা, গ্রাম বাংলার সমাজ কাঠামোর উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল তুলে ধর।
অথবা, বাংলার সমাজ কাঠামোর উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কী প্রভাব পড়েছিল তার বর্ণনা তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটা নিশ্চিত ও সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করানোর জন্য গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত এক নতুন ব্যবহার প্রস্তাব করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৯৩ সালে তা অনুমোদিত হয়। এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে খ্যাত। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী
বন্দোবস্ত প্রথা কার্যকর হয়েছিল ।
বাংলার সমাজ কাঠামোর উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণি জমির চিরস্থায়ী মালিকে পরিণত হয়। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে এই জমিদার শ্রেণি অধীনস্থ প্রজাদের নিকট থেকে
কর আদায়ের ক্ষমতা পায়। তবে জমিদারগণকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা সরকারকে দিতে হতো। এই খাজনা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করতে পারলে তাদের জমিদারি বংশানুক্রমে বজায় থাকত। আবার জমিদারগণ প্রজাদের জমি বন্দোবস্ত দিত এবং তাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করতো। জমিদার কর্তৃক সরকারকে দেয় খাজনার পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু জমিদারগণ প্রজাদের নিকট থেকে বর্ধিত হারে খাজনা আদায় করতো। তবে জমিদারগণ নির্দিষ্ট দিনে খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে জমিদারি নিলামে বিক্রি হতো। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলিত ছিল এবং এই দেশে এই ব্যবস্থা জমিদারি প্রথা নামে অধিক পরিচিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা যেসব ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
১. জমিদারগণ জমির বংশানুক্রমিক, স্থায়ী ও একচ্ছত্র মালিক হবে। নিজস্ব জমি তারা যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার বা হস্তান্তর করতে পারবে এবং এতে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন পড়বে না।
২. রায়তরা হবে জমিদারদের অধীনস্থ প্রজা। তবে আইনে রায়তের প্রতি সুব্যবহার এবং রায়তের সাথে সুসম্পর্ক। স্থাপনের জন্য জমিদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
৩. জমির খাজনা চিরস্থায়ীভাবে এবং একবারেই নির্ধারিত হবে।
৪. নিয়মিত ও নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জমিদারকে খাজনা পরিশোধ করতে হবে এবং এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোন অজুহাত সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না ।
৫. বিচার, পুলিশী ও শুল্ক আদায় প্রথা শক্তিশালী করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে যুক্তি ছিল যে, জমির প্রকৃত মালিক হবার ফলে জমিদারগণ আপন স্বার্থেই জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ উৎসাহী হবে এবং এতে কৃষির প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তাৎক্ষণিক ফলাফল ছিল ভারতীয় ভূমি মালিকানার বিন্যাসের আমূল পরিবর্তন। যেহেতু নির্ভরযোগ্য কোন জরিপ ব্যতিরেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল তাই কোন জমিদারিতে সম্পদের অতিরিক্ত আবার কোনটিতে নিম্নকর ধার্য করা হয়। ফলে কর জর্জরিত অধিকাংশ জমিদারিগুলো সূর্যাস্ত আইনে নিলামে বিক্রি করা যায় এবং এগুলোর নতুন মালিকরা হলেন এমন সব ব্যক্তিরা যারা ছিলেন হয় সহকারী কর্মচারী, নয়ত জমিদারের কর্মচারী অথবা বেনিয়া মুৎসুদ্দী, ব্যবসায়ী, মহাজন প্রভৃতি। পুরানো সামন্ত শ্রেণির পরিবর্তে এরাই এখন জমিদার শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং ধনী মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্মান ও শক্তি লাভ করে। পুরানো জমিদারদের সাথে এদের প্রধান
চারিত্রিক পার্থক্য ছিল এই যে, এরা জমিতে বহুমধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করে এবং নিজেরা অনুপস্থিত ভূমি মালিকে পরিণত হয়। ফলে রায়ত প্রজাদের সাথে এদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে একদিকে যেমন সমাজের জটিলতার বিবিধ
শ্রেণি ও মর্যাদাগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের বহুদফা আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে রায়ত নিপীড়িত ও সর্বাস্বান্ত হয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধি এ অবস্থাকে আরো তীব্রতর ও ত্বরান্বিত করে। জমিদার ও মধ্যস্বত্ব ভোগীদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন এবং জনসংখ্যাবৃদ্ধির কারণে কৃষির খানিকটা সম্প্রসারণ ঘটে কিন্তু তাতে কৃষির কিছুমাত্র উন্নতি সাধিত হয়নি । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার সমাজ কাঠামোর এক মৌলিক তথা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সূচনা করে। যেমন-
প্রথমত, এই বন্দোবস্ত তখনকার বাংলার সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনের উপকরণে (জমিতে) ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করে যা উৎপাদন সম্পর্ককে শোষণের সম্পর্কে রূপান্তর করে।
দ্বিতীয়ত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এমন এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রয়াস যা উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি করার পরিবেশ সৃষ্টি করে। কেননা এতে কৃষক মূলত, ভূমিস্বত্বহীন প্রজা বা কৃষি মজুরে পরিণত হয়। আবার যেহেতু জমিদার জমি কেনাবেচা করতে পারে তাই কোনো কৃষক পারতপক্ষে জমি ক্রয় করেও নিতে পারে। আর এটা একেবারে অসম্ভব ছিল না। বস্তুত এতে ধনী, মাঝারি এবং দরিদ্র কৃষক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। তাই সামাজিক বৈষম্য ও স্তরবিন্যাস ব্যাপকতা লাভ করে।
তৃতীয়ত, জমিদার শ্রেণির বংশধরেরা আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষিত ও সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পরিণত হয়। এ ধরনের একটি শিক্ষিত সমাজ সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব প্রাক-ব্রিটিশ যুগের ভারতে ছিল না। এরা ক্রমে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিতে তথা চাপসৃষ্টিকারী এলিটে পরিণত হয়। পরবর্তীতে অবশ্য ঐ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী চিন্তা প্রকাশ পেতে থাকে, যা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমি তৈরিতে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনটি প্রবর্তনের সাথে সাথে বাংলার সমাজ কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে নতুন শ্রেণির সংযোগ ঘটে এবং এতে শিক্ষিত এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয় যারা ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান ঘটাতে সফলতা লাভ করেছিলেন।