অথবা, মানুষের জীবনধারায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির প্রভাব বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের অধিবাসীদের আর্থসামাজিক জীবনধারায় ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা
অথবা, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর উপর ভৌগোলিক প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সমাজ ও জনগোষ্ঠীর উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা ও কর্মকাণ্ড তার দেশের ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বসবাসরত মানুষের জীবনপ্রণালি ক্রিয়াকার্যের সাথে ভূপ্রকৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও নিবিড়। ভূপ্রকৃতির কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের মানুষ ও তাদের আচার বিশ্বাস ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও মানুষ
বর্বর, সাহসী, কর্মঠ আবার কোথাও অলস, অকর্মঠ। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ দেখা যায়, আবার কোথাও অনুন্নত দেশ দেখা যায় । ফলে পৃথিবীর কোনো স্থানে জীবনযাত্রা সহজ ও সাবলীল আবার কোথাও বন্ধুর প্রকৃতির।
মানুষের জীবনধারায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির প্রভাব : বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, এজন্য এ সকল এলাকায় চা শিল্পের উন্নয়ন লক্ষ করা যায়। সমতল ভূমিতে কৃষিকার্যে ব্যাপক উন্নতি দেখা যায়, শীতকালে সমতল ভূমিতে ব্যাপক রবিশস্য হয়। পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে বলে সেখানে প্রচুর বৃক্ষ জন্মে এবং বনভূমির সৃষ্টি হয়। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণে বিখ্যাত সুন্দরবন যা লবণাক্ত পানির প্রভাবে গড়ে উঠেছে এটি একটি বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। এ বন থেকে সংগৃহীত হয় মূল্যবান কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ। পাহাড়ি অঞ্চলে হয় চা, রাবার, আনারস ইত্যাদি। ভূপ্রকৃতির কারণে সড়ক, রেল ও জনপথ সৃষ্টি হয়, যা সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে। ভূপ্রকৃতি দ্বারা মানুষের সমগ্র জীবনধারা পরিচালিত হয়। যেমন-
১. মানুষের জীবনধারা : মানুষের জীবনধারা ও ভূপ্রকৃতির মধ্যে রয়েছে গভীর যোগসূত্র, সামগ্রিক জীবনযাত্রার উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও জীবনযাত্রা কঠিন আবার কোথাও সহজ। যেমন- পার্বত্য অঞ্চলে জীবনযাত্রা কঠিন, আবার সমতলে সহজ প্রকৃতির। আবার কোথাও জীবনযাত্রা নিম্নশ্রেণির আবার কোথাও উন্নত প্রকৃতির। ভূপ্রকৃতির কারণে সমতলে ঘনবসতি আর পার্বত্য অঞ্চলে বসতি কম দেখা যায়।
২. চারিত্রিক গঠন : ভূপ্রকৃতি দ্বারা মানুষের চরিত্র গঠিত হয়। চরিত্র গঠনে ভূপ্রকৃতি সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। যেমন- বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা কঠোর পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে, সমতলের লোক অলস ও আরামপ্রিয় হয়। আবার উষ্ণ জলবায়ু হলে সে অঞ্চলের লোকের মেজাজ রুক্ষ প্রকৃতির হয়ে থাকে ।
৩. জীৰনজীৰিকা নিৰ্বাহ : ভূপ্রকৃতির কারণে জীবনজীবিকা বিপরীতমুখী হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের জীবিকা ভিন্ন প্রকৃতির দেখা যায়। সমতল ভূমি উর্বর হওয়ায় সহজে ফসল ফলে। অন্যদিকে, পাহাড়ি অঞ্চলে সহজে ফসল ফলে না, তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
৪. ব্যবসায় বাণিজ্যের উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব : ব্যবসায় বাণিজ্যের উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কারণ ভূপ্রকৃতির উপর নির্ভর করে ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষকরে সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তারতম্য লক্ষ করা যায়।
৫. খাদ্যাভ্যাস : ভূপ্রকৃতির কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যাভ্যাস দেখা যায়। পাহাড়ি অঞ্চলের লোকেরা বনের থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রকার খাবার খায়। অন্যদিকে, সমতলের লোক উৎপাদিত কৃষিসামগ্রী “ভোগ করে।
৬. “যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব : যোগাযোগ ব্যবস্থা ভূপ্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক হওয়ায় এখানে নিম্ন এলাকায় যোগাযোগের মাধ্যম হলো নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার। সমতল অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে কাঁচাপাকা রাস্তা যা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করেছে। আবার পাহাড়ি অঞ্চল সমতল না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত।
৭. কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রভাব : মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠে ভূপ্রকৃতি দ্বারা। বাংলাদেশে সমতল ভূমির৷ মানুষেরা সংস্কৃতির চর্চা বেশি করে থাকে। পাহাড়ি ও সমতল ভূমির লোকদের মধ্যে ভূপ্রকৃতি বা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি ভিন্নতর পরিলক্ষিত হয়।
৮. শিক্ষার উপর প্রভাব : ভূপ্রকৃতি শিক্ষার উপর প্রভাব বিস্তার করে। সমতলের বাসিন্দারা বেশি করে সাহিত্য ও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে পারে। পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা সাহিত্যকলা গবেষণার সব সুযোগ পায় না। এছাড়া শীতল ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের জলবায়ু শিক্ষার প্রতিকূলে প্রভাব বিস্তার করে।
৯. শিল্পায়ন : শিল্পায়নের উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। সাধারণত নদীর তীরে শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে। যেমন— রাজশাহীর রেশম শিল্প, সিলেটের চা শিল্প, রাজশাহী অঞ্চলের চিনিশিল্প প্রভৃতি।
১০. নগরায়ণে প্রভাব : নগরায়ণের বিস্তার ঘটে সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী স্থানে। বাংলাদেশের ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এছাড়া নারায়ণঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। চট্টগ্রাম নগর বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। ফলে নগরায়ণে ভূপ্রকৃতির প্রভাব ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ।
১১. অপরাধ সৃষ্টিতে ভূপ্রকৃতি : ভূপ্রকৃতির কারণে অপরাধ প্রবণতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি। অন্যদিকে, সমতল অঞ্চলে অপরাধ প্রবণতা কম। এছাড়া ভূপ্রকৃতির কারণে নগরে বেশি মাত্রায় অপরাধ সংগঠিত হয়।
১২. ভাষাগত প্রভাব : ভূপ্রকৃতিগত কারণে ভাষাগত প্রভাব দেখা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় ভাষা দেখা যায় । বাংলাদেশে সমতল ভূমির ভাষা হলো বাংলা। অন্যদিকে, পাহাড়ি বিভিন্ন উপজাতি নিজস্ব ভাষায় কথা বলে । ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ভূপ্রকৃতির প্রভাব দ্বারা এদেশের জনগণ গভীরভাবে প্রভাবিত। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়সহ সমগ্র কর্মকাণ্ড ভূপ্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। কাজেই সকলের উচিত ভূপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশবান্ধব জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলা।