বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা ও কর্মকাণ্ড তার দেশের ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
বসবাসরত মানুষের জীবন প্রণালি ক্রিয়াকার্যের সাথে ভূপ্রকৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও নিবিড়। ভূপ্রকৃতির কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম মানুষ ও তাদের আচার বিশ্বাস বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি স্বাধীন দেশ। এদেশের ভূপ্রকৃতি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে এদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন কার্যক্রম ভূপ্রকৃতির প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাবসমূহ : বালাদেশের ভূপ্রকৃতি তিন ধরনের। এ তিন ধরনের
এলাকায় তিন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও জীবনযাত্রা কঠিন আবার কোথাও সহজ । যেমন- পার্বত্য অঞ্চলে জীবনযাত্রা কঠিন, আবার সমতলে সহজ প্রকৃতির। আবার কোথাও জীবনযাত্রা নিম্ন শ্রেণির, কোথাও উন্নত প্রকৃতির। ভূমির গঠন ও পার্থক্য বিবেচনা করে বাংলাদেশের যে ৩টি ভূপ্রকৃতি লক্ষ করা যায়
সেগুলো হলো :
১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়।
২. প্লাইস্টোসিন কালের পাহাড়।
৩. সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি।
এই ৩টি ভূপ্রকৃতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলে সেগুলো হলো :
টারশিয়ারি যুগের পাহাড় ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব : টারশিয়ারি যুগে হিমালয় পর্বত গঠিত হওয়ার সময় এ সকল পাহাড় সৃষ্টি হয়। এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ বাঁশ, বেত জাতীয় উদ্ভিদ জন্মে। এছাড়া বৈলাম বৃক্ষ এখানে পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে ছোটো ছোটো ঝোপজঙ্গল ও বৃক্ষরাজি বিদ্যমান। এখানকার মানুষ সাধারণত এগুলোর সাথে সম্পর্কিত হয়ে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে।

প্লাইস্টোসিন কালের পাহাড় ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব : এখানে প্রাকৃতিক গ্যাস, চুনাপাথর, কয়লা প্রভৃতি খনিজ রয়েছে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এখানে ধান, পাট, তামাক, ভুট্টা, পান উৎপন্ন হয়। কাঁঠাল ও গজারি বৃক্ষসহ নানা কৃষিজ ফসল প্রচুর জন্মে।
সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব : এ অঞ্চলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
• কুমিল্লা সমভূমি : এখানে বর্ষাকালে ডুবে থাকে এবং প্রচুর কৃষি ফসল উৎপন্ন হয় ।
• সিলেট সমভূমি : এ অঞ্চলে শীতকালে পানি নেমে গেলে বোরো ও ইরি ধানের চাষ হয়। এখানে হাওর রয়েছে।
• পাদদেশীয় প্লাবন ভূমি: এখানে ধান, পাট, ইক্ষু, তামাক জন্মে।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাবসমূহ : বাংলাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে। আর এটি যখন বঙ্গোপসাগর থেকে আসে তখন এসব পাহাড়সমূহে বাধা পেয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটায়। ফলে বাংলাদেশের কৃষির জন্য এটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু এসব পাহাড়ে সামান্য বাধা প্রাপ্ত হয়ে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ফলে বাংলাদেশের প্রধান রবি শস্য এ সময়ে জন্মে। কিছু পাহাড়ি অঞ্চল রয়েছে যেখানে অনেক বৃষ্টি হয়ে বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এসব বনভূমি থেকে প্রচুর
মূল্যবান কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। পাহাড়ের ঢালে চা, রাবার, আনারস জন্মে। মধুপুর অঞ্চল থেকে গজারি কাঠ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। যেসব এলাকায় নদীবাহিত উর্বর পলল মৃত্তিকা রয়েছে সেখানে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহণ জনবসতি ইত্যাদির বিশেষ উন্নতি হয়ে থাকে। এখানে সমতল ভূমি ও বহু নদনদী থাকায় সড়ক, রেল, জলপথে পরিবহণের বিশেষ উন্নতি হয়েছে।
এদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমির লবণাক্ত ভূমির প্রভাবে বিশাল বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর গুরুত্ব অনেক। কারণ উৎপাদিত কাঠের ৬০% এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এদেশের প্রধান ২টি সমুদ্রবন্দর ভগ্ন উপকূলের প্রভাবে তৈরি । যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতি ও প্রসারে ভূমিকা পালন করে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব অপরিসীম। অর্থনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সবক্ষেত্রে এ প্রভাব বিদ্যমান। ভূপ্রকৃতিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হয়ে থাকে। তবে এদেশের ভূপ্রকৃতি কৃষিনির্ভর হওয়ায় এখানকার অর্থনীতিও কৃষিকেন্দ্রিক। কৃষিকাজই অধিকাংশ মানুষের পেশা। এছাড়াও আরো বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছে।