বাংলার বার ভূইয়াদের উপর একটি নিবন্ধ লিখ।

উত্তর : ভূমিকা : ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তীকাল হতে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বার ভূঁইয়াদের আবির্ভাব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের মধ্যে বাংলার শেষ স্বাধীন নরপতি দাউদ খানের পতনের পর থেকে বার ভূঁইয়াগণ বিভিন্ন সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্যে অনেকে এ সময়কার বাংলাদেশকে “বার ভূঁইয়ার দেশ” হিসেবে অভিহিত
করেন। R.C.Roy বলেন, “The independent chief, that arose in Bengal after the fall of Daud Karrani receved the populer name of Baro-Bhuiyans.” – Ref: The
History of Bengal.P-60..
→ বাংলার বার ভূঁইয়াদের পরিচয় : ভূঁইয়া শব্দটি শুদ্ধ ভাষায় ভৌমিক বা ভূ-স্বামী হতে গৃহীত। তবে বার ভূঁইয়া বলতে বার প্রধান বা “বারজন প্রধান জমিদার” বুঝায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে | জ বাংলার বিভিন্ন অংশে তখন বড় বড় জমিদার ও আফগা অভিজাতগণ নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। এরা নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এক জোট হয়ে মুঘল বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। স্থানীয় এসব জমিদারদের প্রত্যেকের নিজস্ব সেনাবাহিনী ও শক্তিশালী নৌবহর ছিল। বাংলার ইতিহাসে এই জমিদারদের বার ভূঁইয়া বলা হয়। আসলে এদের সংখ্যা ঠিক বার ছিল কি না তা জানা যায় নি। আসলে এখানে বার ভূঁইয়া বলতে অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারকে বুঝানো হয়েছে ।
→ বার ভূঁইয়াদের ইতিহাস : বাংলার ইতিহাসে বার ভূঁইয়াদের সংগ্রামী ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল :
১. ঈসা খান : বাংলার বার ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন সোনারগাঁও এর ঈসা খান। ঢাকা, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে তার রাজ্য গঠিত ছিল । তিনি ভাটি অঞ্চলে একটি বিশাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি খিজিরপুর, এগারসিন্ধু ও ময়মনসিংহের জংগলবাড়ীতে দুর্গ নির্মাণ করেন! কররানী সুলতান দাউদ পতনের পর তিনি বার ভূঁইয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করেন। রাজা মানসিংহ ও দুর্জন সিংহের মতো বহু মুঘল সেনাপতিও তাকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন। তবে শেষ জীবনে
তিনি সম্রাট আকবরের কর্তৃত্ব স্বীকার করেন। সম্রাট তাকে “মসনদ- ই-আলা” ও “মর্জুবানে বাংলা” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৫৯৯
সালে ঈসা খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খান তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিও পিতার ন্যায় তেজস্বী ছিলেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের
আমলে সুবাদার ইসলাম খান তাকে পরাজিত করেন।
২. মুসা খান : পূর্ববঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার ঈসা খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খান ভাটি অঞ্চলের জমিদার হন। মুঘল
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে তিনিই ছিলেন বার ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। শেষ দিকে ঈসা খান মৌখিকভাবে মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করলেও মুসা খান মুঘলদের প্রাধান্য।অস্বীকার করে আজীবন তাদের সাথে সংগ্রাম করেন। তিনি ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা অঞ্চল নিয়ে একটি শক্তিশালী
জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর ১৬০৮ সালে মুঘল সুবাদার ইসলাম খানের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন।
৩. প্রতাপাদিত্য : বাংলার বার ভূঁইয়াদের মধ্যে যশোহরের প্রতাপাদিত্য একজন বিশিষ্ট জমিদার ছিলেন। যশোহর, খুলনা, বাকেরগঞ্জ জেলার সমন্বয়ে তার রাজ্য গঠিত ছিল। তার রাজধানী ছিল ধুমঘাটে। তার নির্মিত বিভিন্ন ইমারতের মধ্যে দরবার ঘর, হাম্মামখান, ঈশ্বরপুরে বিভিন্ন সৌধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু
বারবার পরাজিত হয়ে বিনাশর্তে মুঘল প্রভুত্ব স্বীকার করে নেন।
৪. কেদার রায় : কেদার রায় ছিলেন স্বাধীন জমিদার । ঢাকা জেলার বিক্রমপুর ও ফরিদপুরের একাংশে তার ভ্রাতা চাঁদ রায়ের
জমিদারি ছিল। রাজধানী ছিল শ্রীপুর। তার সমর্থক ছিল মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুগণ। তিনি বহু পর্তুগিজ জলদস্যুকেও তার
সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ বীর ও সুদক্ষ সামরিক শাসক। ১৬০৪ সালে মুঘল সুবাদার মানসিংহ কেদার
রায়কে বিক্রমপুরের নিকট সংঘটিত যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি করেন। এ অবস্থায় সম্ভবত তার মৃত্যু হয়।
৫. কন্দর্পনারায়ণ : বাকেরগঞ্জ জেলার একাংশ নিয়ে কন্দর্পনারায়ণের জমিদারি ছিল। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র রামচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি লাভ করেন। ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যকেও তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত মুঘলদের হাতে পরাজিত হন।
৬. বাহাদুর গাজী : ভাওয়ালের গাজী পরিবারের বাহাদুর গাজী সমসাময়িক ভূঁইয়াদের মধ্যে ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তার বিশাল ও শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। তিনি মুসা খানকে মুঘলদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাহায্য করেন। কিন্তু মুঘলদের হাতে
মুসা খানের পরাজয় ঘটলে তিনি মুঘলদের প্রভুত্ব স্বীকার করেন।
৭. সোনাগাজী : সোনাগাজী ছিলেন ত্রিপুরা জেলার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সরাইল পরগনার জমিদার। তিনিও অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন এবং তার অনেক রণতরী ছিল। তবে তিনি
মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। তবে সম্ভবত তিনি পূর্বেই মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন ।
৮. লক্ষ্মণ মাণিক্য : সম্রাট আকবরের রাজত্বে ভুলুয়ার লক্ষ্মণ মাণিক্য ও তার পুত্র অনন্ত মাণিক্য নামে দুজন প্রভাবশালী ভূঁইয়া
রাজত্ব করত। তাদের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর ও আরাকান রাজ্যের সংযোগ ছিল। পরবর্তীকালে মুঘলগণ ভুলুয়া অধিকার করলে তা তাদের নৌবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
৯. মুকুন্দ রাম রায় : ভূষণার হিন্দু জমিদার মুকুন্দ রাম রায়ের উত্তরাধিকারীগণ সহজেই মুঘলদের কর্তৃত্ব মেনে নেয় এবং অন্যান্য জমিদারদের বিরুদ্ধেও মুঘল বাহিনীকে সহায়তা করে ।
১০. ওসমান খান : ওসমান খানও ছিলেন একজন শক্তিশালী জমিদার ও দুর্ধর্ষ পাঠান বীর। তিনি ময়মনসিংহ জেলার বুকাইনগর অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঈসা খানের সাথে যোগ দিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি সুবাদার ইসলাম খানের সাথে
বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও নিহত হন।
১১. চাঁদগাজী : মানিকগঞ্জের চাঁদগাজীও বার ভূঁইয়াদের মধ্যে কম প্রভাবশালী ছিলেন না। তার জমিদারি ছিল মানিকগঞ্জের চাঁদ প্রতাপে। তিনি বীরত্বে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ
করেন। গাজী পরিবারের পরবর্তী ভূঁইয়া ছিলেন বাহাদুর গাজী।
১২. অন্যান্য অঞ্চলের জমিদারগণ : বাকুড়ার বীর হাম্মির, রাজশাহীর পীতাম্বর রায় এবং দিনাজপুরের প্রমথ রায় প্রমুখ ভূঁইয়াগণ নিজ নিজ এলাকায় মুঘলদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তারা সকলেই সর্বোতভাবে শ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া ঈসা খানের পুত্র মুসা খানের সাথে সম্মিলিতভাবে মুঘল আক্রমণ
প্রতিহত করতে তৎপর হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের অধিকৃত রাজ্যগুলো মুঘল বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত হয়েছিল ।
উপসংহার : বার ভূঁইয়াগণ বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করে তা এদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেষ পর্যন্ত মুঘলদের কাছে পরাজিত হলেও তারা যে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাকে স্বাধীন ও মুক্ত রাখার জন্যে তারা যে এক গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম করে গেছেন তা আজও এদেশের জনগণের মনে গভীর রেখাপাত করে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%98%e0%a6%b2-%e0%a6%86%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ae/