অথবা, বাউল কারা? তাঁদের জীবনাচার সম্পর্কে যা জান লিখ ।
অথবা, বাউল বলতে কাদের বোঝানো হয়? বাউলদের জীবনাচার ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউলদের পরিচয় দাও। বাউল জীবনাচার বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাঙালির ধর্ম, মনন, দর্শন ও সাহিত্য বিশেষ করে সংগীত সাধনার ইতিহাসে বাউল মতবাদ একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। মধ্যযুগের শেষ অন্তে বাংলার বর্ণ বিভক্ত সমাজ কাঠামোতে একেবারেই নিম্নবর্ণের অধিকার বঞ্চিত সাধারণ মানুষের জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত বাস্তবমুখীন চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রতিফলন হচ্ছে বাউল ধর্ম ও দর্শন। যদি বাউল ধর্ম ও দর্শন একটি সমন্বয়মূলক চিন্তাধারা অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম ও মতের প্রভাবজাত তথাপি বলা হয় বাউল মত বাংলার ধর্ম, বাঙালির ধর্মী একান্তভাবে বাঙালির মানস ফসল। কেননা বিভিন্ন মতধারার মূলসারকে গ্রহণ করে একান্তভাবে বাঙালির নিজস্ব মনন ও মর্জিতে বিকশিত হয়েছে বাউল মত। বাউলরা মূলত একটি সংগীত আশ্ৰয়ী সাধনধর্মী সম্প্রদায়। আর এ মতাদর্শের অনুসারীরাই আমাদের নিকট বাউল নামে পরিচিত।
বাউল : বাংলার এক শ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, একতারা আশ্রয়ী, সংসার বিরাগী, উদাসী, ধর্মোন্মাদ, ক্ষ্যাপা,আত্মকর্ম সমাহিত, ভাববিদ্রোহী গায়ক, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমি সাধকের নাম বাউল । বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা প্রধানত বাংলার নিম্নবর্ণের লোক। বাংলার নিম্নশ্রেণির অগণিত জনসাধারণ একসময় বৌদ্ধ সহজিয়া মতের উপাসক ছিল। ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় মুসলমানদের আগমন এবং চতুর্দশ শতক থেকে হিন্দুরাজ্যের অবসানের ফলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিপত্তি হ্রাস পায়। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সমাজের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ধর্ম ও সংস্কৃতি সীমিত হয়ে পড়ে। বর্ণ বিভক্ত হিন্দু সমাজে নিম্নবর্ণের লোকেরা তখন অধিকার হারিয়ে অর্থনৈতিক শোষণ ও
সামাজিক নিগ্রহের শিকার হন।অন্যদিকে, মুসলমান ধর্মপ্রচারকেরা এ সময় শাসকদের ছত্রছায়ায় জোরেসোরে ধর্মপ্রচার শুরু করে। মুসলমান ধর্মপ্রচারকদের মানবতার বাণী এবং বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতির কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।যারা ইসলাম গ্রহণ করে তারা ছিল সম্ভবত কৌম সমাজের লোকজন। তাদের অধিকাংশই গোয়ালা, জেলে, চাড়াল প্রভৃতি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। ফলে তারা ধর্মান্তরিত হলেও পূর্ব-অনার্য সাধনা ও সংস্কৃতির ধারাটি ত্যাগ করতে পারেননি বরং তারা গোপনে সেই পুরাতন আচার অনুষ্ঠান অনুসরণ করে চলে। এ মুসলমান বাউলদের ‘নেড়ার ফকির’ বলা হয়।
নিম্নবর্ণের অন্য অংশ যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি, তারা ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের দ্বারা অবহেলিত ও সমাজ থেকে বহিষ্কৃত
অবস্থায় থাকার কারণে বৌদ্ধ সহজিয়া মতকে আশ্রয় করে কালক্রমে বাউল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। তাই বাউল ধর্মমতের সাধকদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে। মুসলমান ফকির ও হিন্দু বাউল ও রসিক বৈষ্ণব সবাই একই মতাবলম্বী, একই সাধন পদ্ধতি ও একই তত্ত্বের উপাসক। সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ শ্রেণির সমস্ত সাধককে এককথায় ‘বাউল’ বলা হয়। অর্থাৎ বাউল শব্দটি তত্ত্বজ্ঞানী, প্রেমিকভক্ত, পার্থিব আকর্ষণ ও সংসার লোভ- লালসার ঊর্ধ্বে অবস্থিত সংসার ত্যাগী মরমি সাধককে বুঝানোর জন্যই বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্যের দাবি রাখে যে, বাউল নামটি বাউল সম্প্রদায়ের নিজেদের দেয়া নাম নয়। বাংলার এক শ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, একতারা আশ্রয়ী, ভাববিদ্রোহী গায়ক, প্রেমে পাগল, উদাসী, ক্ষ্যাপা, আপনহারা, সংসার বিরাগী, ব্যতিক্রমধর্মী জীবনযাত্রার অনুসারী মরমি সাধককে সাধারণ মানুষ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা বাউল নামে অভিহিত করে থা কেন।
বাউলদের জীবনাচার : বাউলরা বাংলার একটি লোকজ সম্প্রদায়। আচার-আচরণ, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ,সাধন ক্রিয়া প্রভৃতি দিক থেকে বাউলদের জীবনাচার ও জীবনদর্শন প্রচলিত সমাজের স্বাভাবিক ধারা থেকে স্বতন্ত্র। তাই বাউলদর্শনে অভিজ্ঞ একজন পণ্ডিত মন্তব্য করেছেন, পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন,আচার ব্যবহার, ধর্মবিশ্বাস, কর্ম-সাধনা ইত্যাদি দিক দিয়ে যারা সমাজে বসবাসকারী অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, যারা আপনভাবে মশগুল ও উন্মাদ তাঁরা বাউল । অর্থাৎ বাউলদের জীবনাচরণ জীবনদর্শন স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাউলরা সমজর সাধারণ লোকের সাথে মেলামেশা করতে অনিচ্ছুক। তাঁরা সর্বদাই আত্মেগোপন করে থাকে। তাঁদের সাধনা ও আচার ব্যবহার সাধারণ লোকের কাছে অস্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান হয়। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. আমিনুল ইসলাম বলেন, “বাউলরা আধ্যাত্মিক ধ্যানে মগ্ন থাকেন, জগৎ সংসারকে উপেক্ষা করেন এবং সামাজিক আচার আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে চলেন।” তাঁদের জীবনাচার প্রচলিত সাধারণ ধারার বাইরে বলেই তাদের পাগল বা ক্ষ্যাপা বলা হয়। তাঁরা নিরন্তর একটা ভাবের ঘোরে জীবন কাটায় । এ ভাবের ঘোরেই সমাজ ও সংসারকে উপেক্ষা করে তাঁরা নিজের মনের সঙ্গেই লীলা করে। শামুকের মতো
আত্মসংকোচনশীল ও আত্মগোপনশীল জীবনযাত্রার রীতি বাউলদের অবশ্য এ জীবনযাত্রা সম্পর্কে তাঁরা সর্বদা সচেতন। তাঁরা কিভাবে সাধনা করে, কি সেই সাধনার আনুষঙ্গিক কর্ম। কি তাঁদের মতবাদ এসব তাঁরা অন্যকে জানতে দিতে চায় না। তবে সকল বাউলরা একই সাধন প্রণালির অনুসারী, একই তত্ত্বের উপাসক। বাউলরা অতিসাধারণ ও সহজসরল জীবনযাপন করে। আড়ম্বর জীবন তাদের জন্য নয়, বরং তাঁরা দারিদ্র্যকে স্বাগত জানায়। এমনকি কোনো কোনো বাউল ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনধারণ করে। তাঁরা একতারাকে আশ্রয় করে সাদাসিধে পোশাকে জনপথ থেকে জনপথে সংগীত পরিবেশন করে তাঁদের মত প্রকাশ করে। সমাজের অন্যের ব্যাপারে তাঁরা যেমন নিশ্চুপ থাকেন। তেমনি অন্যরাও তাঁদের
ব্যাপারে নাক গলাবে না এটাই তাঁদের প্রত্যাশা। বাউলদের জীবনদর্শন তাঁদেরকে বিষয়ে অনাসক্ত করে রাখে। তাঁদের মধ্যে দু’ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতি লক্ষ করা যায়। যথা : গৃহী ও বিরাগী। বিরাগী বাউলরা গান করে বেড়ায় ও ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবনধারণ করে। গৃহী বাউলরা সংসার ধর্ম করে তবে বিষয়ের প্রতি আসক্তি তাঁদের জীবনধারার একটি মূল বৈশিষ্ট্য। বাউলদের জীবনদর্শন প্রকাশ পায় তাঁদের গানের মাধ্যমে নানাপ্রকারের রূপক ও অস্পষ্ট ইঙ্গিত ও ব্যঞ্জনার দ্বারা। অপ্রকাশ থাকে তাঁদের জীবনদর্শনের বাস্তব প্রয়োগের সাধন পদ্ধতি। তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি অনুগত নয়। কারণ তাঁদের মতে, ধর্মের বাহ্য আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে প্রকৃত ধর্মকর্ম সাধিত হয় না। ধর্মের জন্য চাই অকৃত্রিম হৃদয়ানুভূতি, চাই অপরোক্ষ স্বাজ্ঞিক প্রতীতি। তাঁদের কোনো লিখিত শাস্ত্র, ইতিহাস বা দর্শন নেই। তাঁরা কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না বা দিতে ইচ্ছুক নয়। কারণ তাঁদের জীবনদর্শন বা সাধন ক্রিয়াকলাপের গূঢ় তত্ত্ব প্রকাশের অনুমতিও তাঁদের নেই।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিসমাপ্তিতে বলা যায়, বাউলদের জীবনাচার ও জীবনদর্শনের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাউলরা সমাজের স্বতন্ত্র সম্প্রদায়। সহজ সরল বিষয়ে অনাসক্ত সাধনকেন্দ্রিক জীবনযাপনেই তাঁদের আগ্রহ। তাই দেখা যায় বৈষ্ণব ও সুফিদের ন্যায় বাউলদের জীবন এক ধরনের ভাবোচ্ছ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!