বাংলাদেশ দর্শনে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশ দর্শনে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনে কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু সাহিত্যের ইতিহাসে নয়, দর্শনের ইতিহাসেরও অপরিহার্য নাম। যে সাহিত্যিকের রচনায় দর্শনবোধের অভাব থাকে তা পরিপূর্ণভাবে সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে না। তিনিই যথার্থ সাহিত্যিক হিসেবে পরিগণিত হন যাঁদের লেখার মধ্যে দর্শনের ছোঁয়া থাকে। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ সাহিত্যিক S.T. Colridge বলেছেন “No man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosopher.” এদিক থেকে কবি নজরুলকে একজন বিশিষ্ট দার্শনিকের মর্যাদা দেওয়া যায়। নজরুলের চিন্তাধারা বাংলাদেশ দর্শনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশ দর্শনে নজরুলের অবদান : জীবনের সাথে দর্শনের জীবনকেন্দ্রিক অর্থ ও ব্যানার নিরিখেই তিনি রচনা করেছেন জীবনদর্শন। দারিদ্র্যের কঠোরতা, যুদ্ধের হিংস্রতা প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি রচনা করেছেন উৎপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। নিম্নে বাংলাদেশ দর্শনে তাঁর অবদান তুলে ধরা হলো:
১. বিদ্রোহী মনোভাব : নজরুল জন্ম নিয়েছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। স্বাভাবিকভাবেই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, দরিদ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁর কাব্য, উপন্যাস, নাটকে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। যৌবনকালে যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিদেশি শাসনের গ্লানি, বঙ্গভঙ্গ প্রভৃতি বিষয় তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
২. ব্যবহারিক দর্শন : নজরুল তাঁর দর্শনে ব্যবহারিক দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর মতে, যে দর্শন মানুষের উপকারে আসে না, তার কোনো মূল্য নেই। তাই তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যবহারিক দর্শন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, যাতে দেশের গরিব-দুঃখী মানুষ দুঃখ-যন্ত্রণা হতে মুক্তি পায়।
৩. মানবধর্মী চিন্তা : নজরুলের দর্শনে মানব সম্পর্কিত আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। নজরুল দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেই উপলব্ধি করেছেন সর্বহারা শ্রেণির দুঃখদুর্দশা। তাই তিনি সর্বত্র সর্বহারার জয়গান গেয়েছেন। তিনি তাঁর কবিতা, সাহিত্য, গানে মানবপ্রেমের প্রকৃত ছবি তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত মানবতাকামী মানুষ।
৪. বৈশ্বিক মানবতাবাদ: নজরুল কোনো বিশেষ শ্রেণির মানবপ্রেমের কথা বলেননি। তিনি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য প্রেমের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, “আমি এ দেশে, এ সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এ দেশেরই, এ সমাজের নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কেউ বলে আমি মুসলমান, কেউ বলে কাফের, আমি বলি দু’টির কোনটাই নই। আমি শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করার চেষ্টা করেছি।”
৫. প্রতিবাদী নজরুল : নজরুলের দর্শনের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তিনি তাঁর দর্শনে সকল প্রকার অন্যায়,অবিচারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। তিনি এসব অন্যায়, অবিচার হতে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করে সৃজনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
৬. সত্য ও সুন্দরের পূজারি: নজরুল ইসলাম সত্য ও সুন্দরের পূজারি। তিনি সমাজ থেকে সকল প্রকার মিথ্যা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস দূর করে সত্য ও সুন্দরের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের কথা বলেন। কাজেই সত্য প্রতিষ্ঠা তাঁর দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৭. অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা : নজরুলের মতে, “ধর্মের কথাই বলি আর দর্শনের কথাই বলি, সর্বত্রই মানুষ বিবেচিত হয় মানুষ হিসেবে। শোষিত, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানব অস্থিও উদ্দাম হয়ে উঠেছে।” তাঁর মতে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে অনৈক্য দুঃখজনক। তাই কবি তাঁর সাম্যবাদী কাব্যে বলেছেন,
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।
যেখানে মিশ েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।”
৮. সাম্যবাদ : এ উপমহাদেশে সাম্যবাদ তথা মানবতাবাদ স্ফুরিত ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল নজরুল ইসলামের বিভিন্ন কাব্যে, সাহিত্যে, গানে ও অভিভাষণে। তিনি সকল মানুষকে এক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ভাবতে চেয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীকে একদেশ হিসেবে। ফলে তিনি হয়েছিলেন বিশ্বনাগরিক।
৯. নারী-পুরুষের সমানাধিকার : নজরুল সমাজের শোষিত বঞ্চিত ভাগ্যাহতদের পক্ষে যেমন কাজ করেছিলেন, তেমনি সচেতন ছিলেন নারীর অধিকার ও নারী-পুরুষের সমতা সম্পর্কে। নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাঁর অতি পরিচিত বাণী হলো,
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
১০. নারী শিক্ষা : কাজী নজরুল ইসলাম নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস দূর করার কথা বলেন। তাঁর মতে, এ কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের জন্য বাঙালি নারীরা আজ বিশ্বের দরবারে অবহেলিত। তাই তিনি বাঙালি নারীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরামর্শ দেন।
১১. স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণ : স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণের জন্য নজরুল আজীবন নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর দর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বমানবতার স্থায়ী কল্যাণ সাধন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, কাজী নজরুল সত্য, সুন্দরের পূজারি। তিনি কখনই ন্যায়, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে পিছপা হননি। সারাবিশ্ব যখন মানবাধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করছে, তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ইসলাম তাঁর এ দার্শনিক সুলভ চিন্তাচেতনা বাংলাদেশ দর্শনের গতিধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।