বাংলাদেশে শিল্পায়নের বাধাসমূহ কী কী? এগুলো দূরীকরণের উপায় কী?

অথবা, বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ ব্যাখ্যা
পন্থাসমূহের বিবরণ দাও।
অথবা, বাংলাদেশে শিল্পায়নের সমস্যাবলি তুলে ধর। এ সমস্যা দূরীকরণে উপায়সমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
শিল্পায়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কারখানা ও যন্ত্রপাতিতে উচ্চ মাত্রায় পুঁজি বিনিয়োগ, শিল্পোৎপাদন কৌশলে বিজ্ঞানের প্রয়োগ এবং উৎপাদন এককের ভিতর বিশেষায়িত কাজের জটিল সহযোগিতার সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের বাধাসমূহ : বাংলাদেশের মতো দেশের শিল্পায়িত না হওয়া বা দ্রুত শিল্পায়িত না হওয়ার কারণে অনেকটাই তার ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের শিল্পায়নের বাধাসমূহ নিম্নরূপ :
১. ঐতিহাসিক পটভূমি : বাংলাদেশের ইতিহাসের দীর্ঘসময় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকতে হয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তি এদেশকে অনেক শোষণ করেছে। ফলে দেশটির আর্থসামাজিক ভিত বরাবরই থেকেই দুর্বল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কখনই বাংলাদেশের এ অঞ্চলে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো পদেক্ষপ গ্রহণ করেননি।
২. কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি : গ্রামকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কারুশিল্প, বুননশিল্প ইত্যাদির সাথে বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবন জীবিকার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এর ফলে এ অঞ্চলে ভারী শিল্পের বিস্তার তেমনভাবে ঘটেনি।
৩. উদ্যোক্তার অভাব : মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিতে সক্ষম এমন উৎসাহী ব্যক্তি তথা উদ্যোক্তার অভাব থাকায় বাংলাদেশ শিল্পায়নে পিছিয়ে রয়েছে। শিল্পায়নের অনুরাগী দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে না উঠায় বাংলাদেশ শিল্পোন্নয়নে পিছিয়ে আছে।
৪. আধুনিক প্রযুক্তি তথা কারিগরি জ্ঞানের অভাব : আধুনিক শিল্পায়ন বহুলাংশে দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং উচ্চতর প্রযুক্তিক জ্ঞান নির্ভর। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দক্ষ ও প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী একটি জনসম্পদ গড়ে তোলার কার্যকরি কোন নীতি গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে শিল্পায়ন প্রত্যাশিতভাবে গড়ে উঠেনি।
৫. মানব সম্পদের অভাব : উন্নততর প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিযোগিতামূলক শিল্পের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সেই প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য বিপুলায়তন জনশক্তি শেষ পর্যন্ত জন সম্পদে পরিণত হতে পারছে না।
৬. ক্ষুদ্র বাজার : শিল্পায়নের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি। আর বাড়তি উৎপাদন ভোগ করার জন্য প্রয়োজন সম্প্রসারণশীল ভোক্তা শ্রেণি। বাংলাদেশের ভোক্তা শ্রেণি আয়তনে ক্ষুদ্র হওয়ায় বৈদেশিক পুঁজিকে ততটা আগ্রহী হতে দেখা যায় না।
৭. অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধার অভাব: শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ, বাজার ব্যবস্থার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
৮. পুঁজির অভাব : শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ আর বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন পুঁজি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন প্রণালি এখনো অনুসৃত হওয়ার জন্য পুঁজির ভীষণ অভাব পরিলক্ষিত হয়।
৯. প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব : শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন প্রাকৃতিক সম্পদ। যেমন- জ্বালানি তেল, লৌহ, ইস্পাত প্রভৃতি যা অনেক উন্নয়নশীল দেশেই নেই। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মিষ্টি পানি এবং জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের প্রাচুর্য থাকলেও উপযুক্ত নীতিমালা, আনুষঙ্গিক সুবিধা, বিনিয়োগযোগ্য অর্থ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে এই অমূল্য সম্পদের সর্বোচ্চ দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
১০. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : একটি শিল্প প্রকল্প স্থাপনের পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের শিল্পায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এক বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।
১১. রাজনতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এদেশের শিল্পায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, সরকার বিরোধী আন্দোলনে সহিংসতা, হরতাল, ধর্মঘট প্রভৃতি এদেশের শিল্পায়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
১২. দেশাত্মবোধের অভাব : স্বদেশি শিল্পের বিকাশের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার ও দেশপ্রেমের প্রয়োজন তা আমাদের অনেকের মাঝেই নেই । এছাড়াও বিদেশি পণ্যের প্রতি মোহ আমাদের দেশীয় শিল্পের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের বাধা দূরীকরণের উপায় : বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. রাজনৈতিক দর্শন : সরকারি নীতি এবং উৎপাদনের এমন রাজনৈতিক দর্শন প্রয়োজন যাতে দেশে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে অনেকে উদ্যোগী হন।
২. উচ্চতর প্রশিক্ষণ : শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন। অতএব, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে যে কেবল শিল্প উদ্যোগীরাই লাভবান হবেন তাই নয়, দক্ষ শ্রমিকের অভাব পূরণেও এটা সাহায্য করবে।
৩. স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ : দেশে একটি গণতান্ত্রিক তথা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন । রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সকলকেই আরো আন্তরিক হতে হবে।
৪. মূলধন গঠন : মূলধন গঠনে উদ্বুদ্ধ করা এবং যাদের প্রয়োজনীয় মূলধন রয়েছে তারা যাতে নির্বিঘ্নে নিরাপত্তারোধের সাথে শিল্পকারখানায় লগ্নি করতে উৎসাহী হতে পারে তেমনি একটি অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৫. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : অনেক সময় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। প্রয়োজনীয় উপাদান দেরিতে পাওয়া বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেরি হওয়ার ফলে প্রকল্প বেড়ে যায়। তাই শিল্প স্থাপনের উপাদান সহজলভ্য করার জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কাঁচামালের সহজলভ্যতা সৃষ্টি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, পুঁজি বিনিয়োগ প্রভৃতির মাধ্যমে এদেশের শিল্প স্থাপনের এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায় ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/